জানি না। অনেকদিন ট্রেনে উঠি না।
আচ্ছা, এরা কি সারারাত বাতি জ্বালিয়ে রাখবে? না ঘুমুবার জন্যে বাতি নেভাবে?
তাও তো জানি না।
ট্রেন তো কোথাও থামছে না। এটা কি কোথাও থামে না?
তৌহিদ বলল, কী জানি, ভৈরবে হয়ত থামবে। আমি আসলে কিছুই জানি না। জার্নিটা তোমার কেমন লাগছে রিমি?
ভালো।
শুধু ভালো? এর বেশি কিছু না?
খুবই ভালো।
এরকম চমৎকার জার্নি করেছ কখনো?
না।
রিমি জানালা দিয়ে মুখ বের করে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ এই মুহূর্তে সে একটি মিথ্যা কথা বলেছে। মিথ্যা কথা বলার জন্যেই তার লজ্জা লাগছে। এরকম চমৎকার একটি ভ্রমণ সে এর আগেও একবার করেছিল। ময়মনসিংহ থেকে গিয়েছিল গৌরীপুর। কী অপূর্বই না ছিল সে ভ্ৰমণ। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল এই যাত্ৰা যেন শেষ না হয়। গ্রামগঞ্জ, পথ-মাঠ-ঘাট সব ছাড়িয়ে এই ট্রেন যেন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। কত আবেগ,কত উত্তেজনায় ভরা সেই যাত্ৰা। আনন্দে সেদিন বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। আজও পানি আসছে। অথচ দুটি ভ্রমণ কতই না আলাদা।
ঐ চাওয়ালা আবার এসেছে। ভারি গম্ভীর গলায় বলছে, চা লাগবে, চা?
তৌহিদ বলল, চা খাবে রিমি?
খাব।
বাহ্ চমৎকার। বাইরে কী দেখছ?
কিছু না। অন্ধকার দেখছি।
বাইরে অন্ধকার নেই। চাঁদ উঠেছে। গাছপালা, গ্রাম সব অস্পষ্টভাবে চোখে আসছে। যেন স্বপ্নদৃশ্য। স্বপ্নের মতই কোমল এবং রহস্যময়। রিমির চোখ ভেজা। কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম-রজনী নিঝুম।
তূর্ণা নিশীথা ছুটে যাচ্ছে। ইঞ্জিনচালককে আজ বোধ হয় গতির নেশায় পেয়েছে। ক্রমেই গাড়ির গতি বাড়ছে। লাইন ছেড়ে গাড়ি ছিটকে বেরিয়ে যাবে না তো!
রিমি আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদটাও গাড়ির গতির সঙ্গে তাল রেখে ছুটে যাচ্ছে। ছোটবেলায় এই ব্যাপারটা রিমিকে খুব বিস্মিত করত। সে যেখানেই যায় চাঁদটা তার সঙ্গে-সঙ্গে যায় কেন? খুব ছোটবেলায় সে তার বাবার সঙ্গে নৌকায় করে মোহনগঞ্জ থেকে বারহাট্টায় যাচ্ছিল। পূর্ণিমা রাত। সে অবাক হয়ে লক্ষ করল চাঁদটাও তাদের সঙ্গে-সঙ্গে যাচ্ছে। সে বিস্মিত গলায় বলল, বাবা, চাঁদটা আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে যাচ্ছে কেন?
রিমির বাবা বরকত সাহেব কঠিন গলায় বললেন, চুপ করে থাক। খালি কথা, খালি কথা। আর এইখানে বসে আছিস কেন? ছইয়ের ভেতরে যা। ফাজিল কোথাকার।
রিমি নৌকার ছইয়ের ভেতর চলে গিয়েছিল। সেরাতে উথালপাতাল চাঁদের আলোয় অপূর্ব দৃশ্যের সে কিছুই দেখে নি। তার শৈশব এবং কৈশোর আনন্দময় ছিল না। সেই সময়কার কোনো আনন্দময় স্মৃতি তার নেই। কেউ যদি আজ তাকে বলে, তুমি কি তোমার শৈশব ফিরে পেতে চাও? সে বলবে, না।
তুমি কি কৈশোর ফিরে পেতে চাও?
না।
প্রথম যৌবনের কিছু দিন কি তোমাকে ফিরিয়ে দেব?
না।
অতীতের এমন কিছু কি আছে যা তুমি ফিরে পেতে চাও?
হ্যাঁ, চাই।
সেটা কী তুমি বল।
না, আমি বলব না।
ট্রেনের গতি কমে এসেছে। দুবার সিটি বাজাল ট্রেন ভৈরবের ব্রিজের উপর উঠছে। খটাং-খটাং শব্দ উঠছে। রিমি ব্যাকুল হয়ে অনির ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করছে। সে জেগে উঠে লম্বা ব্রিজটা দেখুক। তার শৈশবে কিছু আনন্দময় স্মৃতি যোগ হোক। সে যেন পরবর্তী সময়ে কখনো না বলে আমি আমার শৈশব ফিরে পেতে চাই না। কৈশোর ফিরে পেতে চাই না।
ও অনি ওঠত। মা ওঠত। দেখভৈরবের পুল দেখা ওঠমা ওঠ। লক্ষ্মী মা। এই অনি, অনি।
অনি জেগে উঠেই কান্না-কান্না গলায় বলল, আমি দাদীমার সঙ্গে ঘুমুব। আমি তোমাদের সঙ্গে ঘুমুব না।
সে বালিশটা হাতে নিয়ে বেঞ্চ থেমে নামার চেষ্টা করছে। রিমি বলল, মা এটা ট্রেন। বাসা না। এই দেখ আমরা ভৈরবের ব্রিজ পার হচ্ছিদেখ দেখা
অনি আবারো কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, দাদীমার সঙ্গে ঘুমুব।
তারা কক্সবাজার পৌঁছল
তারা কক্সবাজার পৌঁছল দুপুর দুটায়।
তৌহিদ ভেবে রেখেছিল কোন একটা হোটেলে উঠবে। দামি হোটেল যেমন আছে, কমদামি হলেও নিশ্চয়ই আছে। প্রতিদিন এক শ বা দুশ টাকা দিয়ে থাকার মতো হোটেল নিশ্চয়ই আছে।
তৌহিদের হোটেল সমস্যার সমাধান হল নিতান্তই দৈবক্রমে। বাস স্টেশনে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, মাস্টার সাহেব না?
তৌহিদ তাঁকে চিনতে পারল না। তবু পরিচিত ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল। ভদ্রলোক বললেন, বেড়াতে এসেছেন বুঝি?
জ্বি।
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
জ্বি না।
আমার দুই ছেলেকে আপনি পড়িয়েছেন। শিমু আর হিমু।
ও আচ্ছা-আচ্ছা।
দুই জনেই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল আল্লাহর রহমতে। অঙ্কে লেটার মার্ক ছিল। তৌহিদ কিছুই মনে করতে পারল না, তবে ভঙ্গি করল যে মনে পড়েছে। আমি এখানেই আছি। কৃষি ব্যাংকে। আপনারা উঠবেন কোথায়? কোনো একটা হোটেল-টোটেলে।
সার্কিট হাউসে উঠেন না কেন? আপনি সরকারি হাইস্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার, আপনার তো সার্কিট হাউসে থাকার রাইট আছে। এন ডি সি বললেই হবে। তাছাড়া এখন অফ সিজন, লোকজন নেই। সব খালি পড়ে আছে।
তৌহিদ বলল, দরকার নেই, ঝামেলা করে।
ঝামেলার তো কিছু নেই। একটা ডাবল সিটেড রুমের ভাড়া মাত্ৰ যোল টাকা। আপনি খামাখা কেন তিন চার শ টাকা দেবেন।
তৌহিদ অসহায় ভঙ্গিতে রিমির দিকে তাকাল। সারাদিনের পরিশ্রমে তারা সবাই ভয়ানক ক্লান্ত। ইচ্ছা করছে দ্রুত কোনো একটা হটেলে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে। তাছাড়া অনির শরীর খারাপ করেছে। বাসে তিনবার বমি করেছে। ওদের রাস্তায় ফেলে রেখে সে যাবে সার্কিট হাউসের খোঁজে সার্কিট হাউস হচ্ছে রুইকাতলাদের থাকার জায়গা! সে নিতান্তই একজন স্কুল টিচার।