রাতে অনিকে স্যুয়েটার গায়ে দিয়ে রাখবে। নতুন জায়গা–ফট করে বুকে ঠাণ্ডা বসে যেতে পারে।
আমরা তাহলে মা রওনা হই?
আচ্ছা রওনা হও। ফি আমানিল্লাহ, ফি আমানিল্লাহ।
ট্রেন সাড়ে এগারটায় ছাড়ার কথা ঠিক সাড়ে এগারটায়ই ছাড়ল। তৌহিদের বিস্ময়ের সীমারইল না। সে অনেকদিন ট্রেনে চড়ে না। তার ধারণা ছিল, এ দেশে ট্রেনের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ওদের মর্জিমতো এক সময় ছাড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে–ব্যাপার তা না। ট্রেনের কামরাও সুন্দর। সবার জন্যে সিট আছে। দাঁড়িয়ে যাবার কোনো ব্যাপার নেই।
দুটো মুখোমুখি সিটে তারা বসেছে। তাদের সঙ্গে তৃতীয় এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বললেন, আপনারা মেয়েটাকে এই সিটে বসিয়ে দিন, আমি অন্য এক জায়গায় বসছি। আজ ভিড় কম। গাড়ি ফাঁকা যাচ্ছে।
তৌহিদ এই মানুষটির ভদ্রতাতেও মুগ্ধ হল। আজকাল ভদ্রতার ব্যাপারটা চোখে পড়ে না। বাসে মহিলারা দাঁড়িয়ে থাকেন। বসে-থাকা পুরুষ যাত্রীরা দেখেও না দেখার ভান করেন। উদাস দৃষ্টিতে তারা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন।
রাতের গাডি হহ করে ছটে চলেছে। সট-সট করে স্টেশন পিছে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। টঙ্গির মতো বড় স্টেশনেও গাড়ি থামল না, ছুটে বের হয়ে গেল।
অনি বলল, বাবা আমি কিন্তু সারারাত ঘুমুব না। জেগে থাকব।
আচ্ছা, থাকবে।
আর এই জানালার কাছের জায়গাটা আমার। এখানে কেউ বসবে না।
আচ্ছা।
তৌহিদ সিগারেট ধরাল। রিমি তাকাল, কিছু বলল না। সে ঠিক করে রেখেছে বেড়ানোর এই সময়টায় সে তৌহিদকে কিছুই বলবে না। একটা কড়া কথা বলবে না। একবারও কঠিন চোখে তাকাবে না। তারা কখনো কোথাও বের হতে পারে না। এই প্রথম বের হল। এই আনন্দ যেন নষ্ট না হয়।
রিমি।
বল।
যাত্রায় নিয়ম নাস্তি—এই জন্যেই অসময়ে সিগারেট রালাম। রাগ করছ না। তো?
রাগ করছি না এটা বললে তৌহিদ প্রশ্রয় পাবে, কাজেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রিমি বলল, আমার আগে তুমি কি মার সঙ্গে দেখা করেছ?
না।
দেখা করলে না কেন?
তৌহিদ কিছু বলল না। সে দেখা করে নি কারণ তার খুব খারাপ লাগছিল। বেচারীর এত শখ ছিল।
রিমি বলল, মা আমাকে টাকা দিয়েছেন। তোমাকে বলা হয় নি।
কত টাকা?
অনেক। দুই হাজার সাত শ বিয়াল্লিশ।
বল কী!
সব চকচকে নোট। খরচ করতে মায়া লাগবে।
তৌহিদ খুশি-খুশি গলায় বলল, তাহলে রাজার হাতে থাকা যাবে–কী বল?
মার দেয়া টাকাটা তুমি তোমার মানিব্যাগে রাখবে। তোমার ইচ্ছামতে খরচ করবে।
টাকা খরচ করতে আমার ভালো লাগে না রিমি। উপার্জন করতে ভালো লাগে না, আবার খরচ করতেও ভালো লাগে না। আমি একেবারে বাবার স্বভাব পেয়েছি।
উনি কি তোমার মত চুপচাপ থাকতেন?
না, তা না। বাবার খুব হৈচৈ করা স্বভাব ছিল। তাঁর মাথার মধ্যে নানান রকম পরিকল্পনা ঘুরত। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন শুনি বাবা সাইকেলে করে সারা ভারতবর্ষ ঘুরবেন। এই জন্যে তিন মাসের ছুটি নিবেন। ভালো সাইকেল কেনার জন্যে কিছুদিন খুব ঘুরলেন।
তারপর?
তারপর আর কী? একদিন পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে গেল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাদের ধারণা ছিল তিনি সত্যি-সত্যি বের হয়ে যাবেন এবং আর কোনট দিন ফিরে আসবেন না।
এরকম ধারণা হবার কারণ কি?
কোনোই কারণ নেই। বাবা সবসময় অচেনা জায়গায় যাবার কথা বলতেন, এই থেকে ছোটবেলাতেই আমাদের ধারণা হয়ে গেল বাবা একদিন-না-একদিন আমাদের ফেলে পালিয়ে যাবেন।
এইসব কথাতো আমাকে কখনো বল নি।
বলার মতো কিছু না। তাছাড়া এখন এই গল্প শুনতে ভালো লাগছে অন্য সময় ভালো লাগত না। সংসারের চাপে অস্থির হয়ে থাকলে কিছু ভালো লাগে না। কিছু শুনতে ইচ্ছা করে না।
বিরাট গোল একটা থালায় চায়ের কাপ সাজিয়ে একজন এসে ভরাট গলায় বলছে, চা লাগবে, চা?
তৌহিদ বলল, চা খাবে রিমি?
রিমি সন্ধ্যা মেলাবার পর কখনোচা খায় না। আজ বলল, খাব।
তৌহিদ বলল, চায়ের সঙ্গে আমি একটা সিগারেট খাই?
তৌহিদকে বিস্মিত করে রিমি বলল, খাও।
অন্য সময় এই চা ভালো লাগত না। পানসে ধরনের চা, লিকার হয় নি। চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে রেখেছে তবু খেতে ভালো লাগছে। চায়ের কাপে রিমি ছোট-ছোট চুমুক দিচ্ছে। প্রবল হাওয়ায় রিমির চুল উড়ছে। রিমিকে খুব সুন্দর লাগছে।
তৌহিদ বলল, বাবার খুব শখ ছিল সমুদ্র দেখার। কথায়-কথায় সমুদ্র যে কী বিশাল, কী সুন্দর এইসব বলতেন। বলার সময় তাঁর চোখ-মুখ অন্যরকম হয়ে যেত। কথার মাঝখানে সমুদ্র নিয়ে কী একটা কবিতাও বলতেন।
কি কবিতা?
মনে নেই। একটা লাইন ছিল—হে সমুদ্র, স্তব্ধচিত্তে শুনেছি গর্জন তোমার রাত্রিবেলা।
আহা! উনাকে একবার নিয়ে গেলেই হত। তোমরা পাঠালে না কেন?
আমাদের পাঠাতে হয় নিউনি নিজেই একবার রওনা হলেন। চিটাগাং পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলেন।
কেন?
এরকম অদ্ভুত সুন্দর একটা জিনিস তিনি একা দেখবেন, ছেলেমেয়েরা কেউ দেখবে না—এটা তাঁর ভালো লাগল না। ফিরে আসার পরপর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার মাস দুএকের মধ্যে মারা গেলেন। তাঁর সমুদ্র দেখা হল না।
তৌহিদের গলার স্বরে কোনো গভীর দুঃখ প্রকাশ পেল না। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা শেষ করে অনিকে ঠিকমতো শুইয়ে দিল। বেচারীর সারারাত জাগার পরিকল্পনা ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছে।
রিমি অনির ছোট বালিশটা নিয়ে এসেছে। এই বালিশ ছাড়া সে ঘুমুতে পারে না। সুটকেস খুলে বালিশ বের করে সে অনির মাথার নিচে দিয়ে দিল। শাশুড়ির দেয়া চাদরে গা ঢেকে দিল। হালকা গলায় বলল, ভৈরবের পুল এলে অনিকে ডেকে তুলতে হবে। বৈ যেতে কতক্ষণ লাগবে বল তো?