ফরহাদ ভাই বিড়বিড় করে বললেন, ধর মামাকে যদি বাসায় গিয়ে না পাই?
পাবেন না কেন?
উনি প্রায়ই ট্যুরে যান।
মামা না থাকলে কী–মামী তো থাকবেন।
মামী আমাকে দেখতে পারেন না। তোমাকে সঙ্গে করে ঐ বাড়িতে উঠলে মামী ঘাড় ধরে বের করে দেবেন।
দিলে দিবে। আমরা কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠব। আমার খুব হোটলে থাকার শখ। আচ্ছা ভৈরবে হোটেল আছে তো?
ফরহাদ ভাই সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিষণ্ণ মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখ দেখে মায়ার বদলে রিমির খুব মজা লাগতে লাগল।
গৌরীপুর স্টেশনে ট্রেন-বদল করতে হয়। রিমিকে রুমে বসিয়ে ফরহাদ গেল চা আনতে। তার মিনিট দুএকের মধ্যে রিমির মেজো চাচা এসে বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই এখানে কোথায় যাচ্ছিস…কার সঙ্গে যাচ্ছিস…
রিমি কোনো জবাব দিতে পারল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেজো চাচা আবার বললেন, কি রে, তোর বাবা-মা কোথায়? কার সঙ্গে এসেছিস?
রিমির চিন্তাসূত্র কেটে গেল। জিতু মিয়া এসে বলল, একজন ভদ্রলোক এসেছে।
রিমির বুক ধক করে উঠল। হকচকানো গলায় বলল, কে, কে এসেছে রে?
চিনি না আফা।
চোখে চশমা আছে?
হুঁ।
রিমি ভেবে পেল না সে এই অবস্থাতেই যাবে না কাপড় বদলাবে। সে বালতিতে। কাপড় ভিজিয়েছিল। সাবানপানিতে তার শাড়ি মাখামাখি। চুল বাঁধা নেই। এইভাবে কারো সামনে যাওয়া যায়? কাপড় বদলাতে কতক্ষণ লাগবে? রিমি অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাপড় বদলাল না। যেমন ছিল তেমনি বের হয়ে এসে দেখে ফরহাদ ভাই নন। অপরিচিত একজন মানুষ। মেয়ের জন্যে প্রাইভেট টিউটর চান। সেই বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন।
রিমি কঠিন গলায় বলল, ও বাসায় গিয়ে কাউকে পড়ায় না। আপনি অন্য কারো কাছে যান। ভদ্রলোক অবাক হয়ে রিমির দিকে তাকালেন—এমন চমৎকার মেয়ের কাছে এমন কঠিন স্বরে কোনো উত্তর তিনি হয়ত আশা করেন নি।
কক্সবাজার রওনা
জোবেদা খানম কল্পনাও করেন নি তাঁকে বাদ দিয়েই তারা কক্সবাজার রওনা হবে। শেষ রসা ছিল অনি। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল অনি বিকট চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করবে। সেই অনিও কিছু বলছে না। সে তার নিজের কাপড়চোপড় গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। তার জন্যে আলাদা একটা সুটকেস নেয়া হচ্ছে। সে খুব ব্যস্ত। দাদীর দিকে ফিরে তাকানোরও সময় নেই।
জোবেদা খানম ভেবেছিলেন শেষ মুহূর্তে হয়ত তারা মত বদলাবে। তখন যাতে ঝামেলা না হয় সে জন্যে তিনি নিজেও সব কিছু গুছিয়ে রেখেছেন। ছোট মেয়ের বাসা থেকে একটা বড় ফ্লাস্ক এনেছেন। ফ্লাস্ক ভর্তি চা থাকবে। এই বয়সে একটু পরপর চা খেলে ভালো লাগে। নতুন স্যান্ডেল বড় ছেলে কিনে দিয়েছে। একটা সুতির চাদর কিনেছেন।
এত কিছু করেও কিছু হল না। শেষ মুহূর্তে লক্ষ করলেন তাকে এখানে রেখেই সবাই রওনা হচ্ছে। তাদের ট্রেন রাত সাড়ে এগারটায় পূর্ণা নিশীথা। তারা নটার সময়ই রওনা হল।
জোবেদা খানমের বড় ছেলে একট গাড়ি নিয়ে এসেছে। সে সবাইকে স্টেশনে নামিয়ে মাকে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে। জোবেদা খানমের এই ছেলেও তৌহিদের মতো কথাবার্তা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। এখনো তাই করছে। বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছে। যেন এই পৃথিবী, এই জগৎ-সংসারের সঙ্গে তার কোনোযোগ নেই।
রিমি আর অনি জোবেদা খানমের কাছ থেকে বিদায় নিতে এল। রিমি বলল, মা আমরা রওনা হচ্ছি।
তিনি জবাব দিলেন না, হাতের তছবির মালা দ্রুত ঘুরতে লাগল।
আমাদের জন্য দোয়া করবেন, মা।
আচ্ছা।
আপনাকে নিতে পারছিনা মাশরীরের অবস্থা তত ভালোনা। লম্বা জানি। দিনের মধ্যে অনেকবার আপনাকে বাথরুমে যেতে হয়।
আচ্ছা। আচ্ছা, বুঝলাম তো।
রিমি পা ছুঁয়ে সালাম করল। অনি খুব মজা পাচ্ছে। মা তার দাদীকে সালাম করছে। এই দৃশ্য তার খুব মনে ধরেছে।
অনি দাদীকে সালাম কর।
উহুঁ। আমি করব না।
যাও, দাদীর দোয়া নিয়ে আস। মা ওকে একটু ফুঁ দিয়ে দেন।
জোবেদা খানম নাতনীকে কোলে বসিয়ে মাথায় ফুঁ দিলেন। গাঢ় স্বরে বললেন, ফ্লাস্কটা নিয়ে যাও মা। কাজে লাগবে।
মা, আপনি মনে কোনো কষ্ট নেবেন না।
না কষ্ট আর কী। বেঁচে থাকাই কষ্ট, এ ছাড়া আর কষ্ট কী?
তাহলে আমরা রওনা হই মা?
আচ্ছা-আচ্ছা। তুমি গায়ের চাদরটাও নিয়ে যাও। সমুদ্রের বাতাসে ঠাণ্ডা লাগতে পারে।
চাদর লাগবে না।
আহা নাও না।
রিমি চাদর নিল। জোবেদা খানম বললেন, স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়ে দেখ তো— লাগে কি-না। লাগতে পারে। তোমার পা ছোট।
স্যান্ডেল লাগবে না। স্যান্ডেল আছে।
আহা, নাও না! নতুন স্যান্ডেল। আমি পায়ে দেই নি।
রিমি লক্ষ করল, তার মন খারাপ হতে শুরু করেছে। এই কঠিন শুষ্ক বৃদ্ধার হৃদয়ের গহীনে স্নেহের ফল্গধারা আছে। সব সময় চোখে পড়ে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ঝলসে ওঠে।
এইখানে কিছু টাকা আছে। এটা রাখ। বিদেশ জায়গা। কখন কী দরকার হয়।
ময়লা রুমালে বাঁধা ছোট্ট একটা পুঁটলি তিনি এগিয়ে দিলেন। এটা জোবেদা খানমের সারা জীবনের সঞ্চয়। ছেলেরা যখন যা দিয়েছে, তিনি জমা করে রেখেছেন। ছোট-ছোট নোটগুলো বদলিয়ে বড় নোট করেছেন।
টাকা নেয়ার ব্যাপারে রিমি কোনো আপত্তি করল না। তার টাকা খুব দরকার।
সাবধানে থাকবে মা, যে কোনো জায়গায় রওনা হবার আগে বাঁ পা আগে ফেলবে। আর মনে-মনে বলবে ইয়া মুকাদ্দিমু। মেয়েদের জন্যে বাঁ পা—পুরুষদের জন্যে ডান পা। মনে থাকে যেন।
জ্বি, মনে থাকবে।