তুমি শুধু-শুধু রাগ করছ। এসো ঘুমুতে চেষ্টা করি।
উনার সম্পর্কে আর কিছু জানতে চাও না?
না।
তুমি যা ভাবছ তা না।
আমি কী ভাবছি?
তুমি ভাবছ ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার গভীর প্রেম ছিল। আমি আমার প্রেমিককে নিমন্ত্রণ করেছি। সে আসে নি কাজেই রাগে-দুঃখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
এরকম কিছুই আমি ভাবছি না।
অবশ্যই ভাবছ। মুখে বলছ না–মনে-মনে ভাবছ। একটা বাংলা বই আমি যেভাবে পড়তে পারি তোমাকেও সেইভাবে পড়তে পারি। তুমি কখন কী ভাব, কী ভাব না, সবই আমি জানি।
তুমি তাহলে অন্তর্যামী।
হ্যাঁ, আমি অন্তৰ্যামী। আমি তোমাকে যেভাবে জানি, তুমি আমাকে সেভাবে জান। না। কারণ তুমি জানতে চাও না। আমার প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ নেই। কয়েকদিন পরপর আমার শরীরটা কাছে পেলেই তোমার চলে যায়।
তৌহিদ প্ৰসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, মশারির ভেতর কয়েকটা মশা আছে বলে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ আছে। তবে এই মশা নিয়েও তোমার মাথাব্যথা নেই। তুমি উঠে বাতি জ্বেলে মশা মারবার চেষ্টা করবে না। মশার ব্যাপারে এই মুহূর্তে তুমি কী ভাবছ আমি বলব?
বল।
তুমি ভাবছ মশাগুলো এখন কানের কাছে ভনভন করে বিরক্ত করছে। সাময়িক একটা অসুবিধা সৃষ্টি করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এরা ভরপেট রক্ত খেয়ে ফেলবে তখন আর বিরক্ত করবে না। তখন আরামে ঘুমান যাবে।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, ঠিকই বলেছ।
আমি তো আগেই বলেছি, আমি তোমাকে, বইয়ের মতো পড়তে পারি।
তাই তো দেখছি।
রিমি পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ঐ ভদ্রলোক সম্পর্কে তোমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এক সময় উনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এর বেশি কিছু না।
বিয়ে হল না কারণ আমি তখন ক্লাস টেনে উঠেছি। খুব কম বাবা-মাই এত অল্প বয়েসী মেয়ে বিয়ে দিতে চান। তাছাড়া ঐ ভদ্রলোকদের চালচুলা কিছুই ছিল না। আমাদের বাসায় জায়গির থেকে পড়ত।
তুমি কিন্তু বলেছিলে তোমাদের সামনের বাসায় থাকত।
বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর বাবা তাকে ঘর থেকে বের করে দেন। তখন তিনি আমাদের বাসার সামনে একটা মেস ভাড়া করে থাকতেন। কাজেই তোমার কাছে। আমি মিথ্যা কথা বলি নি।
তৌহিদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোমার দিক থেকে কোনো আগ্রহ ছিল না?
না।
তৌহিদ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদুস্বরে বলল,আমি অবশ্যি শুনেছিলাম তুমি উনার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলে। গৌরীপুর স্টেশন থেকে তোমাকে ধরে আনা হয়।
রিমি শান্ত গলায় বলল, তোমাকে কে বলেছে?
তোমার মেজো দুলাভাই।
কখন বললেন?
অনেক আগে। আমাদের বিয়ের পরপরই বললেন।
তুমি আমাকে এতদিন এটা বল নি কেন?
বললে কী হত?
রিমি রাগের চেয়েও শান্ত গলায় বলল, তখন আমার বয়স ছিল খুব কম। আমি ঠিক…
বাদ দাও। ঘুমাও।
রিমি ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যে বলি না—এই একটা বলেছি। আই অ্যাম সরি।
তৌহিদ বলল, আমার দিকে ফিরে ঘুমাও। একটা হাত আমার গায়ে রাখ। রিমি ফিরল না। তার শরীর মাঝে-মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে। মনে হয় সে কাঁদছে। বাইরে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে জানালায় খটখট শব্দ উঠছে। যে মশাগুলি কানের কাছে ভনভন করছিল তারা এখন আর কিছু করছে না। সম্ভবত তাদের নৈশাহার সম্পন্ন হয়েছে।
জোবেদা খানম কোরান শরীফ পড়ছিলেন
জোবেদা খানম কোরান শরীফ পড়ছিলেন। তার কোলে অনি। তিনি মাথা দুলিয়েদুলিয়ে পড়ছেন, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনিও মাথা দোলাচ্ছে। রিমি ঘরে ঢাকায় অনির মাথা দোলানো আরো বেড়ে গেল সে মার দিকে তাকিয়ে হাসল।
রিমি হাসল না। অনির এই অতিরিক্ত দাদীঘেঁষা স্বভাব তার পছন্দ না। সারাক্ষণ দাদীর সঙ্গে আছে। কোরান শরীফ পড়ছেন; তখনো কোলে বসা। রিমি বলল, কোল থেকে নাম অনি।
অনি হাসিমুখে বলল, না।
জোবেদা খানম কোরান শরীফ পড়া বন্ধ করলেন। রিমির ধারণা হল তিনি কঠিন কোন ঝগড়ার সূত্রপাত করবেন। প্রতিদিন সকালেই তা করা হয়। তা ছাড়া ঝগড়ার উপলক্ষও তৈরি হয়েছে অনিকে কোল থেকে নামতে বলা হয়েছে। কাল রাতে তাঁকে খাবার দেয়া হয় নি। এই ভুল তথ্যও তিনি টেনে আনতে পারেন।
রিমিকে আশ্চর্য করে জোবেদা খানম তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন, আজ এত দেরিতে ঘুম ভাঙল যে বৌমা।
ঘুমুতে দেরি হয়েছিল।
ঠিক আছে, সবদিন কি আর সবকিছু নিয়মমতে চলে? মাঝে-মাঝে অনিয়ম হয়। আমাকেই দেখ না প্রত্যেকদিন ভাবি কোরান মজিদ পড়ব। পড়া আর হয় না। কতদিন পর আজ বসলাম। এক পারা পড়া হয়ে গেছে।
রিমি তাকিয়ে রইল। তার শাশুড়ির আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ সে ধরতে পারছে না।
বৌমা, একটু বস, কথা বলি।
রিমি বসল না। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল। জোবেদা খানম চোখ থেকে চশমা খুলতে-খুলতে বললেন, আমি কাপড়চোপড় কী নিব তাই তো বুঝতে পারছি না। ঐখানে এখন শীত না গরম?
কোথায় শীত না গরম?
কক্সবাজার।
কক্সবাজার?
অনি বলল, আমরা সবাই যাচ্ছি।
এই কাজটা মা খুব ভালো করেছ। এই জীবনে তো কিছু দেখলাম না। সমুদ্রটা দেখি। তোমার শ্বশুর সাহেব একবার ঠিক করল আমাদের সবাইকে নিয়ে যাবে, তখন খরচপাতির কথা চিন্তা করে আমি বললাম–বাদ দাও। যাওয়া হল না। ঐ বেচারাও দেখল না। আমি দেখলেও কাজের কাজ হয়। মরার পর তোমার শশুর সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে বলতে পারব দেখে আসলাম।
রিমি খাটে এসে বসল। তার মুখ থমথম করছে। সে কঠিন-কঠিন কিছু কথা এখন তার শাশুড়িকে শোনাবে। কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। জোবেদা খানম বললেন, তোমার শ্বশুর সাহেবের এইসব বাতিক খুব ছিল। এখানে যাবে, ঐখানে যাবে। অবশ্য কোথাও শেষ পর্যন্ত যেতে পারে নি। যাবে কীভাবে? টাকাপয়সা কই? ছেলে-মেয়ে মানুষ করতে গিয়ে জিহ্বা লম্বা হয়ে গেল। যাক এখন আর পুরানো কথা বলে লাভ কি। তা বৌমা আমরা রওনা হচ্ছি কবে?