কী আজেবাজে কথা বল রুনকি? মুখ কালো করব কেন?
আমি সরি মা।
ঠিক আছে খেতে বাস।
নিশানাথ বাবু নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছেন। আমিন সাহেব একবার বললেন, রান্না কেমন হয়েছে নিশানাথ বাবু?
নিশানাথ বাবু তার জবাব দিলেন না। তিনি কখনো অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাব দেন না। রুনকি বলল, নিশা চাচার জিহ্বায় কোনো টেষ্টব্যাড নেই। তিনি যাই খান তাই তাঁর কাছে ঘাসের মতো লাগে। তাই না চাচা?
নিশানাথ বাবু তার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তখন টেলিফোন বাজল। টেলিফোন ধরল রাহেলা।
হ্যালো, আমি শফিক।
রাহেলা শুকনো গলায় বললেন, আমরা সবাই খেতে বসেছি, একটু পরে ফোন করতে পার?
রাহেলা কঠিন মুখ করে খেতে বসলেন। রুনকি মায়ের দিকে না তাকিয়ে বলল, মা, এটা কিন্তু তুমি ঠিক করলে না।
রাহেলা উত্তর দিলেন না। নিশানাথ বাবু বললেন, প্রচুর আয়োজন করেছেন। মনেই হয় না বিদেশ।
রুনকি বলল, মা ওদের হয়তো বিশেষ কোনো ঝামেলা হয়েছে। টেলিফোন নামিয়ে না রেখে তোমার উচিত ছিল
আমার কী উচিত-অনুচিত তা আমি তোমার কাছ থেকে শিখতে চাই না! তুমি ভাজা মাছ আরো নেবে?
না।
নিশানাথ বাবু, আপনি নেবেন?
নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে বললেন, এটা ভাজা মাছ? আমি ভাবছিলাম…
রুনকি বলল, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ মা। ওদের নিশ্চয়ই বড়ো রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে।
নিশানাথ বাবু বললেন, কাদের ঝামেলা হয়েছে?
যাদের আসবার কথা ছিল, তাদের।
কী ঝামেলা?
সেটা এখনো জানা যাচ্ছে না। হয়তো ভদ্রলোক বাথরুমে গিয়ে দেখেন বাথটাবে একটি ডেডবিডি পড়ে আছে। ডেডাবডিটির পিঠে একটি ওরিয়েন্টাল কাজ করা ছুরি।
আমিন সাহেব হেসে ফেললেন।
হাসির কী হল বাবা? হতেও তো পারে।
নিশিনাথ বাবু বললেন, এদেশে সবই সম্ভব। খুন খারাবি এদের কাছে কিছুই না, অতি অসভ্য বর্বরের দেশ।
ঝামেলাটা কী হয়েছে তা জানা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। গাড়ি নিয়ে হাইওয়েত আটকা পড়েছে। শফিকের প্রাচীন ফোর্ড ফিয়াসটার ট্রান্সমিশন কাজ করছে না। হাইওয়ের একটি রেস্ট হাউসে বসে আছে দু জন। রুনকি বলল, রাস্তার মাঝখানে গাড়ি নিয়ে আটকা পড়া দারুণ এক্সাইটিং।
রাহেলা ভ্রূ কোঁচকালেন। ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, এর মধ্যে এক্সাইটিং কী দেখলে তুমি? সাধারণ মানুষদের মতো ভাবতে শেখ। গাড়ি নিয়ে আটকা পড়াটা হচ্ছে যন্ত্রণা। এক্সাইটমেন্ট নয়।
তুমি এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন মা?
রুনকি, কথা বন্ধ করে গাড়ি নিয়ে ওদের খোঁজে যাও। তোমার বাবাকে পাঠাব না। সন্ধ্যা থেকে মার্টিনি খাচ্ছে, ওর হাত স্টেডি নেই।
কথাটা ঠিক নয়। দু পেগের মতো মার্টিনি আমিন খেয়েছেন। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। রাহেলার মেজাজ চড়ে আছে। চুপ করে থাকাই ভালো। নিশানাথ বাবু বসার ঘরের সোফায় পা গুটিয়ে আবার ধ্যানস্থ হয়েছেন। আমিন তাঁর পাশে এসে বসতেই তিনি বললেন, বুঝলেন, অতি অনুসভ্য, অতি বর্বর জাত।
রাহেলা রুনকির সাথে গ্যারাজ পর্যন্ত গেলেন। রুনকির হাতে চাবি দিয়ে বললেন, নতুন ছেলেটির সঙ্গে খুব ভদ্র ব্যবহার করবে।
রুনকি অবাক হয়ে বলল, আমি অভদ্র মা! কী বলছ তুমি? যা বলছি মন দিয়ে শোন। আমি চাই তুমি বাঙালী ছেলেদের সঙ্গে কিছুটা মেলামেশা কর।
রুনকি চুপ করে রইল। রাহেলা বললেন, তোমার একটি ভালো বিয়ে হোক, সেটাই আমি চাই। আমি তোমাকে হ্যাপি দেখতে চাই।
বাঙালী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলেই আম হ্যাপি হব? তোমার তো বাঙালি ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে। তুমি কি হ্যাপি?
রাহেলা উত্তর দিলেন না।
রুনকি বলল, এইসব নিয়ে আমি এখন ভাবতে চাই না। আর আমি চাই না, তুমিও ভাব। ইদানীং আমাকে নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করছি।
তুমি বলতে চাও, চিন্তার কিছু নেই?
রুনকি গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। রাহেলা বললেন, শাড়ি একটু উপরের দিকে টেনে নাও। এক্সিলেটরের সঙ্গে যেন না লেগে যায়।
হাইওয়েতে নেমেই রুনকি গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে সত্ত্বরে নিয়ে এল। গ্র্যাণ্ড ফোকস থেকে ফার্গো ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ফাঁকা থাকে বলেই পুলিশটুলিশ তেমন থাকে না। যত ইচ্ছা স্পীড তোলা যায় গাড়িতে। রুনকির বান্ধবী শ্যারন এক বার পচানব্বুই পর্যন্ত তুলেছিল। কি প্রচণ্ড কাঁপুনি গাড়ির। রুনকির এতটা সাহস নেই। সত্ত্বরেই তার খানিকটা হাত কাঁপে। তা ছাড়া ফল সিজন বলেই গাছের পাতা ঝরছে। শুকনো পাতার উপর দিয়ে গাড়ি গেলেই অদ্ভুত শব্দ হয়, কেমন যেন ভয়ভয় করে।
আপনাদের নিতে এসেছি আমি।
আনিস মেয়েটিকে দেখে অবাক হল। হালকা-পাতলা গড়নের বাচ্চা একটি মেয়ে। শিশুদের চোখের মতো তরল চোখ। কেমন যেন অভিমানী পাতলা ঠোঁট!
আপনি বুঝি সেই টীচার? আনিস? আনিসের উত্তর দেওয়ার আগেই মেয়েটি বলল, আমি কিন্তু মাস্টারদের একটুও পছন্দ করি না। আপনি আবার রাগ করবেন না যেন।
আনিস হাসিমুখে বলল, না, আমি রাগ করব না।
মাস্টাররা ক্লাসের বাইরে কিছু জানে না। জানতে চায়ও না।
তাই কি? হ্যাঁ। আমি দশ ডলার বাজি রাখতে পারি, আপনি কবি কীটসের প্রণয়িনীর নাম জানেন না।
আনিস বেশ অবাক হল। মেয়েটির মুখ হাসি-হাসি কিন্তু ঝগড়া বাধানর একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা আছে। শফিক তার গাড়ি নিয়ে এখনো ব্যস্ত। তার ধারণা ঝামেলাটা আসলে ট্রান্সমিশনে নয় কারবুরেটরে, আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলেই সে ঠিক করে ফেলতে পারবে।
আনিস একটি সিগারেট ধরিয়ে মৃদু স্বরে বলল, কবি কীটসের প্রণয়িনীর নাম জানা অত্যাবশ্যকীয় বিষয় নয়।