কিন্তু মালিশা ছিল না। ঘরের বিছানা সুন্দর করে পাতা। বিছানার উপর এক টুকরো সাদা কাগজ পড়ে আছে। আনিস দেখল। সেখানে পেন্সিলে লেখা–তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে জাগালাম না। অনেক ধন্যবাদ। আনিসের কেন যেন একটু মন খারাপ লাগল। অথচ মন খারাপ হবার কোনো কারণ নেই। আজকের দিনটি খুবই খারাপ যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এ-রকম খারাপ দিন আসে। কোনো কিছুই ঠিক মতো হয় না।
শফিকের দশ মিনিটের মধ্যে আসার কথা। সে দু ঘণ্টার মধ্যেও এল না। মিস ক্যাথরীনকেও টেলিফোন করে পাওয়া গেল না। ইউনিভার্সিটিতে এখন গিয়ে হাজির হওয়ার কোনো মানে হয় না। আনিসের মনে হল তার জ্বর আসছে। কী ভয়ঙ্কর খারাপ দিন। টিভি-র নিউজ চ্যানেলে পর্যন্ত একটিও ভালো খবর নেই–
ক্যান্টাকিতে দুটি শিশুকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
সল্ট টু ট্রিটির আলোচনা ভেস্তে গেছে।
বেলজিয়ামের লিয়েগো শহরে একটি ট্রেন নদীতে পড়ে দেড় শ লোকের সলিলসমাধি হয়েছে।
বাগানে চেয়ার সাজান হয়েছে।
রুনকির মনে হল, তার মা কিছুটা বাড়াবাড়ি করছে। দু বার টেবিলক্লথ পাল্টান হয়েছে। ফুলদানিতে ফুল সাজান হয়েছে স্টেরিও সিস্টেমকে টেনে আনা হয়েছে বাইরে।
রুনকি বলল, মা তুমি বড্ড হুলস্থূল করছ!
রাহেলা অসন্তুষ্ট হলেন। তাঁর কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল, বাইরে চেয়ার পেতে বসলে বুঝি হুলস্থূল হয়?
তা হয় না, কিন্তু ফুলদানি রাখলে হুলস্থূল হয়। তুমি ছয় ডলার খরচ করে ফুল আনিয়েছ মা।
বেশ তো, তোমার অপছন্দ হলে ফুলদানি তুলে নাও।
রুনকি অপ্রস্তুত হল। তার মা স্পষ্টই রেগে গেছেন। সে তার মাকে ঠিক বুঝতে পারে না। অত্যন্ত ছোট কারণে তিনি অসম্ভব রেগে যেতে পারেন। রুনকি হাসিমুখে বলল, মা, তুমি যদি চাও তাহলে আমি নীল শাড়িটা পরব।
আমার আবার চাওয়াচাওয়ি কি রুনকি? আমি কখনো কারো কাছে কিছু চাই নি।
রুনকি মুখ কালো করে তার ঘরে চলে গেল। এমন একটি চমৎকার দিন কেমন করেই নি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুনকি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। এই ঘরে নিজের মনে কাঁদা যায়। উঁচু ভল্যুমে গান বাজান যায়। এটি তার নিজের গোপন
থৈবী। পৃথি টুকটুক করে টোকা পড়ছে দরজায়। নিশ্চয়ই বাবা। এমন শালীন ভঙ্গিতে বাবা ছাড়া আর কেউ দরজা নক করতে পারেন না। রুনকি নরম গলায় বলল, কী চাও, বাবা?
দরজা খোল বেটি। তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।
কী সারপ্রাইজ?
খুলেই দেখ।
রুনকি রেরিয়ে এল, তার দু চোখ ভেজা। চুল এলোমেলো।
তোমার জন্যে একটি গিফট প্যাকেট এসেছে। ইটালি থেকে। ইটালিতে কে আছে তোমার মা?
টম। সামার কাটাতে গিয়েছে।
রুনকি প্যাকেট খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। প্লাষ্টার অব প্যারিসের তৈরি অপূর্ব একটি নারীমূর্তি। নিশ্চয়ই মাইকেল এঞ্জেলোর কোনো ভাস্কর্যের ইমিটেশন। রুনকি গাঢ় স্বরে বলল, কী সুন্দর, দেখেছি!
শ্যাঁসুন্দর। খুবই সুন্দর।
মাকে দেখিয়ে আনি।
রুনকি ছুটে বেরিয়ে গেল।
রাহেল রানাঘরে। রানাবান্নার কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। খাবার দাবার গরম রাখার জন্যে শুধু ওভেনে দিয়ে রাখা। অনেক রকম আয়োজন হয়েছে, তবু রাহেলার মনে হচ্ছে আয়োজন পূর্ণাঙ্গ হয় নি। কাঁচামরিচ নেই ঘরে। হর্নবাকারসে কাঁচামরিচ পাওয়া যায় নি। তিনি বা আমিন সাহেব কেউ অবশ্যি ঝাল খান না, তবে প্রবাসী বাঙালীরা খাবার টেবিলে কাঁচামরিচ দেখতে ভালোবাসে।
মা দেখ, টম কী পাঠিয়েছে।
কোন টম, পাগলা টম?
রুনকি রেশ বিরক্ত হল। টম আবার ক জন আছে যে, পাগলা টম বলতে হবে? রুনকি বলল, মূর্তিটি আমি বাগানে সাজিয়ে রাখি মা? তোমার অতিথিরা দেখলে অবাক হবে।
রাহেলা থেমে থেমে বললেন, না রুনকি, এটি তোমার ঘরেই থাক। মূর্তিটি অশালীন।
রুনকি স্তম্ভিত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঝড়ের বেগে দোতলায় উঠে গেল।
অতিথিদের মধ্যে প্রথম এলেন নিশানাথ রায়। গ্ৰাণ্ড ফোকস ইউনিভাসিটির অঙ্কের প্রফেসর। ভদ্রলোকের বয়স ৫৫, কিন্তু দেখায় ৭০-এর মতো। লম্বা দড়িপাকান চেহারা। যে-কোনো নিমন্ত্রণে সবার আগে এসে উপস্থিত হন এবং নিরিবিলি একটি কোণ বেছে চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন কিংবা ঘুমান। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতেও ক্লাস নিতে গিয়ে একই কাণ্ড। তবু তিনি টিকে আছেন, কারণ টপলজিতে এক জন প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁকে এখনো ধরা হয় (যদিও টপলজি তিনি ছেড়েছেন দশ বছর আগে)। অনেকের ধারণা, গ্রাণ্ড ফোকাস ইউনিভার্সিটির নাম লোকে জানে, কারণ প্রফেসর নিশানাথ এখানে মাস্টারি করেন।
নিশানাথ বাবু তাঁর স্বভাবমতো পাঁচটার দিকেই এসে পড়লেন এবং লজ্জিত স্বরে বললেন, দেরি করে ফেললাম নাকি?
আমিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, না, দেরি হয় নি। চা দেব, না লিকার?
নিশানাথ বাবু বিড়বিড় করে কী-যেন বললেন। পরিষ্কার বোঝা গেল না। তিনি বেছে বেছে সবচেয়ে পেছনের একটি চেয়ারে পা উঠিয়ে বসলেন। আমিন সাহেব মার্টিনির একটি বড়ো গ্লাস নিয়ে এসে দেখেন, নিশানাথ বাবু চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন।
নিশানাথ বাবু নিন, মার্টিনি এনেছি।
ইয়ে–কি যেন বলে, আমি অবশ্যি চা চেয়েছিলাম।
চা নিয়ে আসতে পারি, পানি গরম আছে।
নিশানাথ বাবু তার উত্তর দিলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন।
রাত আটটা বেজে গেল। অন্য দু জন নিমন্ত্রিতের কোনো খোঁজ নেই। শফিকের ঘরে টেলিফোন করা হল কয়েক বার, কেউ ধরল না। রুনকি বলল, নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হয়েছে মা। তুমি এমন মুখ কালো করে থেক না।