তিনি তাঁর নিজের মেয়েকে একটুও বুঝতে পারেন না। মাঝে মাঝে অনেক কায়দা করে জিজ্ঞেস করেন, তুই কী রকম ছেলে বিয়ে করতে চাস রুনকি?
বিয়ের কথা আমি মোটেই ভাবছি না। বছরের পর বছর একটা ছেলের সঙ্গে থাকা বড্ড আগলি।
এসব আবার কী ধরনের কথা?
সত্যি কথাই বলছি তোমাকে। যে-সব ছেলে আমার সঙ্গে ডেট করে, তুমি কি ভাবছ আমি ওদের কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবি? হলি কাউ। তাছাড়া ওরাও বিয়ে করতে চায় না। ভুলিয়েভালিয়ে ঘরে নিয়ে শুতে চায়।
রাহেলা মুখ কালো করে বললেন, তুই নিশ্চয়ই ওদের ঘরে যাস না?
মা, যাই কি না-যাই সেসব আমি তোমার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই না! আমার বয়েস উনিশ হয়েছে। তোমাদের কোনোই রেসপনসিবিলিটি নেই।
রাহেলা চান একটি হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান বাঙালী ছেলেকে বিয়ে করবে রুনকি। জীবনে যে-সমস্ত সুখ ও আনন্দের কথা তিনি সারা জীবন কল্পনা করেছেন, তাঁর মেয়ে সে-সব ভোগ করবে। কিন্তু এই দূর দেশে তেমন ছেলে পাওয়া যাবে কোথায়? রাহেলা লং ডিসটেন্সে পরিচিত সবাইকে একটি ছেলের কথা বলেন। খোঁজ যে আসে না, তাও নয়। প্রথমেই জানতে চায় মেয়ের কি ইমিগ্রেশন আছে? বিয়ে করলে এখানে থেকে যাবার ব্যাপারে কোনো সাহায্য হবে কি? মেয়ের ছবি দেখতে চায় না, মেয়েটিকে দেখতে চায় না। গ্ৰীন কার্ড দেখতে চায়।
আমিন সাহেব নিজের ঘরে বসে কী যেন লিখছিলেন। একতলার সর্বপশ্চিম কোণার ছোট ঘরটি তাঁর নিজস্ব ঘর। ঘরটিতে আসবাব বলতে ছোট একটা লেখার টেবিল, একটা ইজিচেয়ার, বুকশেলফ। বুকশেলফে কয়েকটি রেফারেন্স বই, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কিছু পুরনো সংখ্যা এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের ইছামতী ছাড়া অন্য কোনো বই নেই। আমিন সাহেব মাঝেমাঝেই দরজা বন্ধ করে এই ঘরে বসে কী-যেন লেখেন। রাহেলা কৌতূহল হলেও কখনো কিছু জিজ্ঞেস এই ঘরে বসে কী-যেন লেখেন। রাহেলার কৌতূহল হলেও কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আমিন সাহেবের কোনো বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতে আজ আর তাঁর ভালো লাগে না।
রাহেলা দরজায় দু বার টোকা দিয়ে মৃদু গলায় বললেন, আসব? জবাব পাবার আগেই তিনি পর্দা সরিয়ে আমিন সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। আমিন সাহেব তাঁর লেখাটি আড়াল করবার চেষ্টা করলেন। রাহেলা ভান করলেন যেন তিনি এসব কিছুই লক্ষ করছেন না।
আমি আজ সন্ধ্যায়। কয়েক জনকে খেতে বলেছি। আমিন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। তুমি টিচি থেকে শুঁটকি মাছ এনে দেবে।
শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়?
মাঝে মাকে যায়।
আমি নিয়ে আসব।
রাহেলার মনে হল আমিন সাহেব অস্বস্তিবোধ করছেন, যেন তিনি চান না রাহেলা এখানে থাকে। কিন্তু এ-রকম মনে করার কারণ কী? রাহেলা নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, কী লিখছ?
তেমন কিছু নয়।
রাহেল খানিকক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে থেকে তোতলায় চলে গেলেন। দোতলার একেবারে শেষ কামরাটি রুনকির। সে দরজা বন্ধ করে গান শুনছে।
রুনকি, দরজা খোল তো মা।
রুনকি দরজা খুলে দিল। তার চোখ ভেজা। মনে হল সে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে।
কী হয়েছে রুনকি?
কিছু না মা। নেইল ডাইমণ্ডের গান শুনছিলাম। ওর গান শুনলে খুব লোনলি ফিলিং হয়।
রুনকি মিষ্টি করে হাসল। রাহেলা থেমে থেমে বললেন, আমি কয়েকটি ছেলেকে খেতে বলেছি। তুমি সন্ধ্যাবেলা যেও না কোথাও।
ঠিক আছে, মা।
তোমার নীল শাড়িটা পরবে।
বেশ। বিশেষ কাউকে আসতে বলেছ?
রাহেলা ইতস্তত করে বললেন, আনিস নামের একটি ছেলে আসার কথা, এনডি-এস-ইউয়ের টীচার, খুব ভালো ছেলে।
কী করে বুঝলে–খুব ভালো ছেলে?
শাফিক বলেছে।
রুনকি হাসি-হাসি মুখে বলল, নিশ্চয়ই আনিমেরিড। এবং নিশ্চয়ই তুমি চাও আমি খুব ভদ্র—নমভাবে তার সঙ্গে কথা বলি।
চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?
না, অন্যায় হবে কেন? তবে মাস্টারদের আমি দু চোখে দেখতে পারি না।
রাহেলা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। রুনকি বলল, তোমার চিন্তার কিছুই নেই। আমি খুব ভদ্র ও নাম ভাবে থাকব, একটুও ফাজলামি করব না। দেখবে, মিষ্টি মিষ্টি হাসছি শুধু।
আনিসের ঘুম ভাঙল
আনিসের ঘুম ভাঙল এগারটায়।
সে কয়েক মুহূর্ত নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না, সত্যি সত্যি এগারটা বাজে। আজ শুক্রবার, সাড়ে নটায় একটা ক্লাস ছিল। তিন শ ছয় নম্বর কোর্স পলিমার রিয়োলজি। এখন অবশ্যি করার কিছুই নেই। মিস ক্যাথরীনকে টেলিফোন করে দিতে হবে। ক্লাস মিস করা তেমন কোনো ব্যাপার নয়। সময় করে নিয়ে নিলেই হবে। কিন্তু ঘুমের জন্যে ক্লাসে না যেতে পারাটা লজ্জার ব্যাপার।
আনিস টেলিফোন হুঁক লাগান মাত্রই টেলিফোন বেজে উঠল।
হ্যালো আনিস ভাই? আমি শফিক।
বুঝতে পারছি।
কাল রাত থেকে এই নিয়ে ছয় বার টেলিফোন করেছি। আপনি কি টেলিফোন ডিসকানেক্ট করে রেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
আমি ভাবলাম, কী ব্যাপার? এদিকে আপনার মহিলা কবির নাম পেয়েছি, নাম হচ্ছে মেরি স্টুয়ার্ট।
আনিস ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, মেরি স্টুয়ার্ট নয়। ভদ্রমহিলার নাম এমিলি জোহান। রাত্ৰে মনে করতে পারছিলাম না, এখন মনে হয়েছে।
আনিস ভাই, আপনার কি শরীর খারাপ?
না, শরীর ঠিক আছে।
আমিন সাহেবের বাসায় যাবার কথা মনে আছে তো?
আজকে তো নয়, কাল।
হ্যাঁ, কাল। শুনুন আনিস ভাই, আমি আসছি।
এখন?
এই দশ মিনিটের মধ্যে। সিরিয়াস কথা আছে।
আনিস টেলিফোন রেখে চায়ের পানি বসিয়ে দিল। পানি গরম হতে–হতে হাতমুখ ধুয়ে আসা যাবে। হাত-মুখ ধুতে গিয়ে মনে পড়ল, আরেকটি প্রাণী আছে। আশ্চৰ্য, এত বড়ো একটা ব্যাপার। এতক্ষণ মনে পড়ল না কেন?