শফিক বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, কী ব্যাপার আনিস ভাই?
কোনো ব্যাপার না, এম্নি জিজ্ঞেস করছি। ভদ্রমহিলার নাম এম দিয়ে শুরু।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কী জন্যে?
আনিস লাইন কেটে দিল। শফিক এখন নিৰ্ঘাত আবার টেলিফোন করবে। কাজেই এখন প্লাগ থেকে টেলিফোন খুলে রাখা উচিত।
আনিসের সারা রাত ঘুম হল না। ঘুম এল ভোরবেলা।
ফার্গো খুবই ছোট শহর
ফার্গো খুবই ছোট শহর।
আমেরিকানরা একে সিটি বলে না, বলে টাউন। সাধারণ একটি সিটিতে যা যা থাকে, এখানে তার সবই অবশ্যি আছে। আকাশছোঁয়া দালানই শুধু নেই। দুটি নাইট ক্লাব আছে। মেয়েরা সেখানে নগ্ন হয়ে নাচে। একটা বড়ো ক্যাসিনো আছে। সেখানে সপ্তাহে ছ দিন দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ব্লাক জ্যাক খেলা হয়। অত্যাধুনিক শপিং মল আছে বেশ কয়েকটি, তবু-ফার্গো সিটি নয়, টাউন। নিউইয়র্ক বা শিকাগো থেকে যে-সব বাঙালী এখানে আসে তারা চোখ কপালে তুলে বলে, আরো এ তো আমাদের কুমিল্লা শহর। ভিড় নেই হৈ-চৈ নেই। বাহ্, চমৎকার তো!
কিন্তু বেশিদিন কেউ থাকে না। এখানে। শীতের সময় প্রচণ্ড শীত পড়ে। কানাডা থেকে উড়ে আসে ঠাণ্ডা হাওয়া। থার্মোমিটারের পারদ ক্রমশ নিচে নামতে থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তাপমাত্রা শূন্যের ত্রিশ ডিগ্ৰী নিচে নেমে থমকে দাঁড়ায়। অসহনীয় অকল্পনীয় ঠাণ্ডা। একটা শীত কোনোমতে কাটাবার পরই ফার্গোর মোহ কেটে যায়। ঘরের মধ্যে ছ মাস বন্দী হয়ে থাকতে পারে কেউ? বাঙালীরা মুখ কুচকে বলাবলি করে, এখানে মানুষ থাকতে পারে? এখানে বাস করতে পারে পোলার বিয়ার আর সীল মাছ।
তবু অনেকেই আসে। ঘরবাড়ি কিনে স্থায়ী হয়ে যায় কেউ কেউ। যেমন স্থায়ী হয়েছেন আমিন সাহেব। শহরে বাড়ি করেছেন। মিনেসোটায় পেলিকেন লেকের ধারে সামার হাউস কিনেছেন। বিশ বছর আগে যে-দেশ ছেড়ে এসেছিলেন, আজ আর তার জন্যে মন কাঁদে না।
অথচ শুরুতে কী দিন গিয়েছে! ইউনিভার্সিটি থেকে সন্ধ্যাবেলা ব্লকান্ত হয়ে ফিরতেন। ঘরে রাহেলা একা। কিছুই করবার নেই। কতক্ষণ আর টিভির সামনে বসে থাকা যায়? একা একা দোকানে ঘুরতে কার ভালো লাগে? আমিন সাহেব সান্ত্বনা দিতেন, আর একটা মাত্র বৎসর। পি… এইচ… ডি করব না। এম… এস… করে ফিরে যাব। আর মাত্র কয়েকটা দিন কষ্ট কর।
পরিবর্তন হল খুব ধীরে। আমিন সাহেব একদিন অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, রাহেলা চমৎকার ইংরেজি শিখেছে।
বাহু, তুমি তো চমৎকার ইংরেজি বল! কোথেকে শিখেছি? একেবারে আমেরিকান এ্যাকসেন্ট। কীভাবে শিখলে?
টিতি দেখে দেখে শিখেছি। কী আর করব বল? দু বছরের মাথায় চাকরি হল রাহেলার। আহামরি কিছু নয়। রিসার্চ ল্যাবে সূর্যমুখী ফুলের চারা বাছা। সেই বছর গাড়ি কিনলেন আমিন সাহেব। নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান মডেল ডজ পোলারা। প্রকাণ্ড গাড়ি। নিজের গাড়িতে করে স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন ডেডিলস লেকে। রাহেলার মনে হল সে বোধহয় আগের মতো অসুখী নয়।
দেখতে–দেখতে কত দিন হয়ে গেল। প্রচুর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে যাওয়া হয়ে উঠল না। বেড়াতে যাবার জন্যেও নয়। একটা-না–একটা ঝামেলা থাকেই। পিএইচ.ডির বছর দেশে যাবে না। নতুন চাকরি, দেশে যাওয়া যাবে না। ইমিগ্রেশন না হওয়া পর্যন্ত বের হওয়া ঠিক হবে না। নতুন বাড়ি কেনা হয়েছে। এখন বাড়ি ঠিকঠাক করতে হবে, দেশে যাওয়া পিছতে হবে। প্রথম বাচ্চা হবে, এ সময়টা তো আমেরিকাতে থাকতেই হবে।
তারা প্রথম বারের মতো যখন দেশে গেল তখন গ্রুনকির বয়স চার বছর। প্ৰায় এক যুগ পর দেশে ফেরা। কি দারুণ উত্তেজনা গিয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে কিছুই ভালো লাগল না। নোংরা ঘরবাড়ি। দেয়ালগুলি ময়লা। রাতের বেলা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগে চারদিক। মানুষজনও কেমন যেন বদলে গেছে। কেউ যেন ঠিক সহজ হতে পারে না। বড় খালা, যিনি সারা জীবন তুই তুই করে কথা বলতেন, তিনি পর্যন্ত তুমি বলা শুরু করলেন।
এক মাস পরই রুনকি পড়ে গেল অসুখে। যা খায়, কিছুই হজম করতে পারে না। রাহেলা আমেরিকা ফিরে এসে হপ ছাড়ল।
দেখতে–দেখতে কত দিন হয়ে গেল। বিশ বছর অনেক লম্বা সময়। রাহেলার বাবা-মা মারা গেলেন। আমিন সাহেবের বাবা-মা তো আগেই ছিলেন না। কোনো পিছুটান রইল না। রাহেলার সবচেয়ে ছোট বোনটির বিয়ে হয়ে গেল। কোথায় আছে সে, কিছুই জানা নেই। জািনবার জন্যে সে রকম উৎসাহও এখন হয় না। সবকিছু যেন হারিয়ে গেছে। আজকাল আয়নায় মুখ দেখলে রাহেলার তীক্ষ্ণ ব্যথা বোধ হয়। মুখের চামড়া শ্লথ হয়ে এসেছে। কানের দু পাশের সাদা চুল সাপের মতো কিলবিল করে। এখন তাঁর অন্য এক ধরনের আলস্য বোধ হয়। সকালবেলা চেয়ার পেতে বারান্দায় একা একা বসে থাকেন। আমিন সাহেব তাঁকে বিরক্ত করেন না। কেমন একটা দূরত্ব এসে গেছে তাঁদের মধ্যে। মাঝে মাঝে রুনকি আসে, ঝড়ের মতো।
আবার তুমি চেয়ার নিয়ে বসেছ? শিকড় গজিয়ে শেষে তুমি একটা গাছ হয়ে যাবে মা।
আয়, তুইও বোস।
হুঁ, আমার যেন কোনো কাজ নেই!
রুনকি দেখতে তাঁর মতো হয় নি, তবু চমৎকার হয়েছে। গায়ের রঙ চাপা, কিন্তু কী কালো শান্ত চোখ। তাকালেই কেমন যেন মন খারাপ হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রুনকি যখন চুল ব্রাশ করে, তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন। রুনকি ঠোঁট বাঁকায়, এমন করে তাকাও কেন মা?
কেমন করে তাকাই?
কেমন যেন পুরুষ-পুরুষ চোখে তাকাও।