ড. লুইস জং বাহাদুরের গায়ে দুটি ইনজেকশন করলেন এবং শফিককে বললেন, একে এখন চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তিন নম্বর খাঁচায় রেখে দাও।
শফিক দেখল জং বাহাদুর ঝিম মেরে গেছে, নড়াচড়া করছে না। খাঁচায় নামিয়ে রাখতেই সে শান্ত ভঙ্গিতে মাঝখানে গিয়ে বসে রইল। শফিক বলল, এই ব্যাটা, কী হয়েছে তোর?
জং বাহাদুর দাঁত বের করল না। জিভ বের করে ভেংচে দিল না। শুধু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল।
ড. লুইস, কী দিয়েছেন ওকে?
হেভি মেটাল পয়জনিং করা হয়েছে। রক্তের মধ্যে মারকারির একটা সল্ট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ও মারা যাবে ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে। আমরা মেটাল পয়জনিংএর এফেক্ট লক্ষ করব। ব্লাড-প্ৰেশার কী করে ফল করে, সেটা মনিটার করা হবে।
শফিকের গা কাঁপতে লাগল। তিন নম্বর খাঁচার সামনে গিয়ে ভাঙা গলায় ডাকল, জং বাহাদুর, জং বাহাদুর।
জং বাহাদুর ঘাড় ঘুরিয়ে থাকল। কী শান্ত দৃষ্টি!
দু নম্বর খাঁচার সব কটি বানর ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জং বাহাদুরের দিকে। ওরা কি কিছু বুঝতে পারছে? ড. লুইস এসে দেখলেন, পিপুল ডাইলেটেড হতে শুরু করেছে, মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। লোহিত রক্ত-কণিকা ফুসফুস থেকে আর রক্ত নিয়ে যেতে পারছে না।
শফিক ক্লান্ত স্বরে বলল, ড. লুইস, বড্ড খারাপ লাগছে আমার।
শফিকের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। জং বাহাদুর তোকাচ্ছে শফিকের দিকে। শফিক মৃদু স্বরে বলল, লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কন্তু মিনায-যোয়ালেমিন।
ড. লুইস অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সেন্টিমেন্টাল ইণ্ডিয়ানস। সিলি সেন্টিমেন্টের জন্যেই ওদের কিছু হয় না। চাইনীজ পোস্ট ডাকটিও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে শফিকের দিকে। সে অস্পষ্ট স্বরে চাইনীজ ভাষায় কী যেন বলল–নিশ্চয়ই কোনো ইস্টার্ন ফিলোসফি। রাবিশ, এসব সেন্টিমেন্টাল ইণ্ডিয়ানদের নিয়ে মুশকিল। এরা বড়ো ঝামেলা করে।
শফিক জং বাহাদুরের খাঁচার শিক দু হাতে ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। জৎ বাহাদুর মনে হল এগিয়ে আসছে তার দিকে। শফিক চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।
মিস মালিশা
মিস মালিশা, তোমার কি রাতে ঘুম হয় নি?
নাহ।
স্নায়ু উত্তেজিত হয়েছিল, সে— জন্যে এই হয়েছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে কোনো একটা সিডেটিভের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন ছিল। ভুলটা আমার।
মালিশা চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল এ্যাটর্নির দিকে। অল্পবয়েসী এই ছোকরাকে বেশ লাগছে তার। সে বলল, আমি তোমার নাম ভুলে গেছি। আই এ্যাম সরি।
আমার নাম ডেনিস বেয়ার। তুমি আমাকে বিল ডাকতে পোর।
বিল, একটি বুইক গাড়ি পাঠাবার কথা বলেছিলাম।
পাঠান হয়েছে।
কে পাঠিয়েছে, কি, কিছুই লেখা নেই তো?
না। কিন্তু মিস মালিশা, কাউকে গিফট দেওয়ার প্রধান আনন্দই তো হচ্ছে গিফট পেয়ে সে কেমন খুশি হল তা জানা, ঠিক নয় কি?
মালিশা জবাব দিল না। ডেনিস বেয়ার মিটমিট করে হাসতে লাগল।
মালিশা বলল, হাসছ কেন?
আজকের ন্যাশনাল ইনকোয়ারারে তোমার ছবি ছাপা হয়েছে। তুমি বিখ্যাত হতে শুরু করেছ।
মালিশা ক্লান্ত স্বরে বলল, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ আমি কোথাও যেতে চাই না।
মিস মালিশা, ডিসট্রিক্ট এ্যাটর্নি অফিসে আজকে এক বার যেতেই হবে। ঘণ্টাখানিকের বেশি লাগবে না, অনেস্ট!
মালিশা জবাব দিল না। ডেনিস বেয়ার একটি সিগারেট ধরিয়ে হাসিমুখে বলল, সেখান থেকে যাব চেস ম্যানহাটনে, কথা দিচ্ছি ত্ৰিশ মিনিটের মধ্যে সব কামেলা চুকিয়ে ফেলব।
আজকে না গেলে হয় না?
না, আজকেই যেতে হবে। ডলার একটি চমৎকার জিনিস। পৃথিবীর মধুরতম শব্দের একটি। কিন্তু শব্দটি মধুময় রাখার যন্ত্রণাও কম নয়।
প্রকাণ্ড একটি ফোর-ডোর শোভ্রোলে গাড়ি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির পেছনের সিটে মধ্যবয়েসী এক জন ভদ্রলোক একটি সামার কোট পরে বসে আছেন। ডেনিস বেয়ার মৃদু স্বরে বলল, ওর নাম জিম। তুমি যখনি বাইরে যাবে, ও ছায়ার মতো থাকবে তোমার সঙ্গে। ও তোমার বডিগার্ড। খুব এফিশিয়েন্ট লোক।
মালিশ ক্লান্ত স্বরে বলল, আমার এসব দরকার ছিল না।
দরকার আছে।
গাড়িতে উঠেই মালিশা বলল, আমার কেন যেন ভালো লাগছে না, কিছুতেই মন বসছে না।
সন্ধ্যাবেলা অপেরা দেখতে চাও?
টিকিট পাওয়া যাবে?
ডলার দিয়ে পৃথিবীর যে-কোনো জিনিস পাওয়া যায়।
তাই কি?
হাঁ। তুমি কী চাও বলবে, আমি ব্যবস্থা করব। ডলারের মতো চমৎকার জিনিস পৃথিবীতে কী আছে?
ডলারের মতো চমৎকার জিনিস পৃথিবীতে নেই, না?
না।
মালিশার মনে হল তার জ্বর আসছে। কিছুই ভালো লাগছে না। গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে জিম বসে আছে। লোকটি মূর্তির মতো, সমস্ত রাস্তায় এক বার শুধু বলল, চমৎকার ওয়েদার মিস মালিশ।
ডিসট্রিক্ট এ্যাটর্নি অফিসে দু ঘণ্টার মতো লাগল। মালিশাকে তেমন কিছু করতে হল না। শুধু চুপচাপ বসে থাকা। মাঝে মাঝে দু-একটা ফর্মে সই করা। এ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গেও মিনিট দশেকের কথাবার্তা বলতে হল। দু ঘণ্টা বসে মালিশার প্রচণ্ড মাথা ধরে গেল।
চেস ম্যানহাটনে যাবার পথে ডেনিস বেয়ার শান্ত স্বরে বলল, মিস মালিশা, আমি বুঝতে পারছি তোমার খুব বিরক্তি লাগছে। কিন্তু উপায় নেই।
চেস ম্যানহাটনে আজ না গেলে হয় না?
না। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
মালিশ চুপ করে গেল। জিম বলল, চমৎকার ওয়েদার, তাই না মিস্টার বেয়ার?