আছে।
আমি কি তোমার একটি সিগারেট ধার নিতে পারি?
আনিস সিগারেট বের করল। মেয়েটি ফস করে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। বাদামী রঙের ঢেউ-খেলান চুল মেয়েটির। টানা টানা চোখ। লাইটারের আলোর জন্যেই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, আনিসের মনে হল মেয়েটির মুখ যেন এইমাত্র কেউ তুলি দিয়ে এঁকেছে।
সিগারেটের জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।
ছেলে-মেয়ে দুটি পিয়ানোর আড়ালে চলে গেল। মেয়েটি অনবরত হাসছে খিলখিল করে। হাসির ধরন কেমন অসংলগ্ন। নিশ্চয়ই প্রচুর বিয়ার খেয়েছে। আনিস লম্বা হয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। ইলেকট্রিসিটি এখনো আসছে না। ট্রান্সমিশন লাইন কোথায়ও পুড়েটুড়ে গেছে বোধহয়। মেয়েটির চাপা গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।
আহ্ কী অসভ্যতা করছ? হাত সরাও প্লীজ।
আবার খিলখিল হাসি। তারপর দীর্ঘ সময় আর কিছুই শোনা গেল না। বাইরে ঝড়ের বেগ বাড়ছে। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আনিস শুয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন ঝড় থেমে গিয়েছে। ইলেকট্রিসিটি এসেছে। মেমোরিয়েল ইউনিয়ন আলোয় ঝলমল করছে। ছেলেটি নেই, মেয়েটি টেবিলে পা তুলে বসে আছে এক এক।
তোমার কাছ থেকে কি আমি আরেকটি সিগারেট নিতে পারি?
আনিস একটি সিগারেট দিল। মেয়েটি সিগারেট ধরিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে?
না। কেন বল তো?
গাড়ি থাকলে তোমাকে একটা লিফটের জন্যে অনুরোধ করতাম।
সরি, গাড়ি নেই আমার।
তুমি থাক কোথায়?
টুয়েলভ এ্যাভিন্যু।
তোমার সঙ্গে আমি টুয়েলভ এ্যাভিন্যু পর্যন্ত হেটে হেটে যেতে পারি, কি বল?
তা পার।
আমার বড্ড মাথা ধরেছে। মেয়েটি বা হাতে তার কপাল টিপে ধরল। আনিস বলল, তোমার ছেলে বন্ধুটি কোথায়?
ও আমার বন্ধু হবে কেন? কোথায় গেছে কে জানে? ওর সঙ্গে বকবক করেই তো আমার মাথা ধরেছে।
বৃষ্টি নেই। কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। রাস্তায় নেমেই মেয়েটি খুব সহজ ভঙ্গিতে আনিসের হাত ধরল।
তোমার এ্যাপার্টমেন্টে কি টাইনানল আছে?
আছে।
মনে হয় আমার জ্বর আসছে। দুটি টাইনানল এবং গরম কফি খেতে পারলে হত।
আনিস কথা বলল না। মেয়েটির সত্যি সত্যি জ্বর আসছে। হাত বেশ গরম।
আমি কি তোমার এ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে এক কাপ গরম কফি খেতে পারি? রাত বেশি হয় নি, তাই জিজ্ঞেস করছি।
হ্যাঁ, খেতে পোর।
আমাকে আরেকটা সিগারেট দাও।
মাথা ধরা তাতে আরো বাড়বে।
আমি তাতে কেয়ার করি না। আমি কোনো কিছুতেই কেয়ার করি না।
তা ভালো।
ভালো হোক, মন্দ হোক, আমি কেয়ার করি না।
বাসার সামনে এসে মেয়েটি থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বলল, এত বড়ো বাড়ি! এটা তোমার?
ভাড়া দিয়ে থাকি। নিজের নয়।
আমি ভেবেছিলাম তুমি স্টুডেন্ট।
না, আমি স্টুডেন্ট নই।
আনিস টাইনানল নিয়ে এল। পানির বোতল আনল। মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার জ্বর আসছে। তোমার কাছে থার্মোমিটার আছে?
না, থার্মোমিটার নেই।
তোমার গাড়ি থাকলে ভালো হত, আমাকে পৌঁছে দিতে পারতে।
আমি আমার এক বন্ধুকে টেলিফোন করছি। সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।
আমি কি তোমার এখানে এক রাত থাকতে পারি? ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার।
আনিস চুপ করে রইল। মেয়েটি থেমে বলল, কি, থাকতে পারি?
তা পার।
আমাকে শোবার ঘর দেখিয়ে দাও। আমার বড্ড খারাপ লাগছে।
শোবার এই ঘরটি চমৎকার করে সাজান। মেয়েটি খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখল অনেকক্ষণ। তারপর খানিক ইতস্তত করে বলল, তুমিও কি শোবে আমার সঙ্গে?
না।
আরো শোবার ঘর আছে?
হ্যাঁ।
মেয়েটি পায়ের জুতা খুলল। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা ছিল, স্কার্ফ খুলে মুখ মুছল। তারপর খুব সহজভাবে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। অবশ্যি তোমার ইচ্ছা! হলে আমার সঙ্গে শুতে পার। আমি কিছুই কেয়ার করি না।
নাম কি তোমার?
মালিশা।
শুভরাত্ৰি মালিশা।
মালিশা কোনো জবাব দিল না। আনিস ভ্রূ কুঞ্চিত করে ভাবল, কাজটা বোধহয় ঠিক হল না। এইসব হোবো শ্রেণীর মেয়েদের ঘরে থাকতে দিতে নেই। হয়তো একটি প্রস্টিটিউট। শহরের নষ্ট মেয়েদের এক জন। কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। মন খারাপ হয় শুধু।
টিভিতে জনি কার্সন শো হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট কার্টার দাঁত বের করে কী ভাবে হাসে, তাই দেখাচ্ছে। আহা মারি কোনো অভিনয় নয়, এতেই স্টুডিওর লোকজন হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে। চ্যানেল ফোরে লেট নাইট মুভি শুরু হল। অর্থাৎ রাত বেশি। হয় নি! একটা এখনো বাজে নি। আনিস কফি বানোল। ঘুমুতে যাওয়ার আগে কফি খাবার এই একটি বিশ্ৰী অভ্যাস তার আমেরিকায় এসে হয়েছে।
মালিশা কি কফি খাবে? সম্ভবত না। মেয়েটিকে থাকতে দেওয়া ভুল হয়েছে। ড্রাগস-ট্রাগস খেয়ে এসেছে কিনা কে বলবে? হয়তো রাতদুপুরে চেঁচামেচি শুরু করবে!
আনিস ঘুমুতে গেল অনেক রাতে। বাতি নেভাবার ঠিক আগের মুহূর্তে মনে হল, আজ সন্ধ্যায় যে মহিলা কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাঁর নাম মনে পড়ছে না। চমৎকার একটি নাম। খুব সম্ভবত এম দিয়ে শুরু হয়েছে। নামটি মনে না-আসা পর্যন্ত কিছুতেই ঘুম আসবে না। ছটফট করতে হবে বিছানায়। পুরনো সেই রোগ আবার দেখা দিচ্ছে। স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠছে। ঘাড়ের পাশের রাগ দুটি ফুলে উঠছে। কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? শফিক তো অনেক দিন ধরে আছে এইখানে, এত রাত্রে টেলিফোন করাটা কি ঠিক হবে?
হ্যালো শফিক? জেগে ছিলে?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
আচ্ছা শোন, তুমি কি এখানকার কোনো মহিলা কবিকে চেন? বেশ বয়স ভদ্রমহিলার।