আরে, তুই এইসব ফাজলামি কোত্থেকে শিখলি?
বানরের বাচ্চাটি কথা শুনে উৎসাহিত হয়েই বোধহয় থু করে এক দল থুথু ছিটিয়ে দিল শফিকের দিকে।
মহা মুসিবত হল তো শালাকে নিয়ে। মারব থাপ্পড়।
বাচ্চাটা গালি শুনে উৎসাহিত হয়ে খুব লাফালাফি শুরু করল। তার আনন্দের সীমা নেই।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে।
আনিস সবেমাত্র ফিরেছে ইউনিভার্সিটি থেকে। হাতমুখও ধোওয়া হয় নি, শফিক এসে হাজির। এক্ষুণি যেতে হবে তার সঙ্গে।
কী ব্যাপার আগে বল।
আগে বললে আপনি আর যাবেন না।
যাব। ঘরে তেমন কিছু নেই। এখন বল ব্যাপারটা কী?
জং বাহাদুরের শয়তানিটা দেখাব আপনাকে। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, শালা ওয়ান নাম্বার হারামী।
জং বাহাদুরটা কে?
ও, আপনাকে তো বলা হয় নি। বাচ্চা একটা বাঁদর। বাচ্চা হলে কী হবে, শয়তানের হাড্ডি। দেখবেন নিজের চোখে।
নিজের চোখে কিছু দেখা গেল না। জং বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছে। শফিক খুব মনমরা হয়ে পড়ল। আনিস হাসিমুখে বলল, কালকে এসে দেখব।
সকাল-সকাল আসবেন। খাবার দেওয়ার সময় হলে কী করে দেখবেন। বিকালবেলা একটা কলা, একটা আপেল আর একটা ডিম সেদ্ধ দেওয়া হয়েছে। শালা কলা ডিমটা খেয়ে আপেলটা আমাকে সাধছে। দেখেন কাণ্ড!
তুমি না বললে শয়তানের হাড্ডি? আমার কাছে তো বেশ ভালোমানুষই মনে হচ্ছে।
আরে না-না, তার বজ্জাতির কথা তো কিছুই বললাম না।
আনিস হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার কি কোনো কাজ আছে শফিক? তোমার গাড়িতে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে?
কোথায়?
আনিস খানিক ইতস্তত করে বলল, একটি মেয়ের সঙেগ আমার কিছু পরিচয় হয়েছে। অনেক দিন তার খোঁজ নেই। ভাবছিলাম একটু খোঁজ নেব।
শফিক বেশ অবাক হল। আনিস থেমে বলল, আমি দেশে ফিরে যাব শফিক। আমার ভালো লাগছে না। আমি ঐ মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
সে কোথায় থাকে?
সাউথ ফার্গো।
চলুন যাই। ফুলের দোকান হয়ে যাবেন? ফুল নেবেন?
ফুল কেন?
শফিক হাসিমুখে বলল, আমেরিকান মেয়েকে বিয়ের কথা কি ফুল ছাড়া বলা যায়? একগাদা গোলাপ নিয়ে যান। ডাউনটাউনে ফুলের দোকান সারা রাত খোলা থাকে।
আনিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ফুল তো কিনতেই হবে।
মালিশাকে পাওয়া গেল না। বাড়িওয়ালী সরু গলায় বলল, ওর মা মারা গেছে। ও গেছে টাকা পয়সা কিছু দিয়ে গেছে কিনা দেখতে।
কবে গিয়েছে?
এক সপ্তাহ হল।
আনিস বলল, ও কি টাকা পয়সা কিছু পেয়েছে?
আমি কী করে জানব? এক শ ডলার রেন্ট বাকি রেখে গেছে সে। আমি চিন্তায় অস্থির, টাকাটা মার গেল কি না।
আমি কি এই গোলাপগুলি তার ঘরে রেখে যেতে পারি?
পারবে না কেন? রেখে যাও। তুমি কি ওর বন্ধু?
হ্যাঁ।
ভালো। আমার ধারণা ছিল, ওর কোনো বন্ধু নেই। আমার দু জন ভাড়াটে আছে, যাদের কোনো ছেলে বন্ধু নেই। এক জন হচ্ছে মালিশা, অন্য জন এমিলি জোহান।
এমিলি জোহান?
হ্যাঁ, কবি এমিলি জোহান, নাম শুনেছ? খুব বড়ো কবি। রাইটার্স গিল্ড এওয়র্ড পাওয়া।
আমি কি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি?
না, পার না। সে এখন মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে।
ফেরার পথে আনিস একটি কথাও বলল না।
আমিন সাহেব শোভেল নিয়ে বেরুলেন
সকালবেলা একটি পার্কা গায়ে দিয়ে আমিন সাহেব শোভেল নিয়ে বেরুলেন। বরফে ড্রাইভওয়ে ঢাকা পড়েছে। পরিষ্কার না করলে গাড়ি বের করা যাবে না। অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছে। চোখ জ্বালা করছে। কনকনে হাওয়া। নাক-মুখ সমস্তই ঢাকা, তবু সেই হাওয়া কী করে যেন শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। অল্পক্ষণ শোভেল চালাবার পর তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বয়স হয়েছে। এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। দিন ফুরিয়ে আসছে। ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। চলে যাবার সময় হয়ে এল। এবারের যাত্রা অনেক দূরে। গন্তব্যও জানা নেই। আমিন সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। রুনকি থাকলে এতটা পরিশ্রম হত না। নিমেষের মধ্যে বরফ কেটে গাড়ি বের করে ফেলত। তারপর ছোটাছুটি শুরু করত বরফের উপর। তুষার বল বানিয়ে চেঁচাত—মারব তোমার গায়ে বাবা? দেখবে আমার হাতের টিপ? মেয়েটা একেবারে ছেলেমানুষ রয়ে গেল।
না, কথাটা ঠিক হল না। রুনকি এখন আর ছেলেমানুষ নয়। আমিন সাহেব বিশ্রাম নেবার জন্যে গ্যারাজের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। তখনই চোখে পড়ল, রাহেলা দোতলার বারান্দায় একটা সাদা চাদর গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডায় এমন পাতলা একটা চাদর গায়ে দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? নিউমোনিয়া বাধাবে নাকি? রাহেলা উপর থেকে ডাকলেন, চা খেয়ে যাও।
চা খেয়ে আমিন সাহেবের মনে হল তাঁর শরীর ভালো লাগছে না। নিঃশ্বাস নিতে একটু যেন কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। রাহেলা বললেন, আজকের এই দিনটি একটি বিশেষ দিন। তোমার মনে আছে?
না।
আজ রুনকির জন্মদিন।
আমিন সাহেব বড়োই অবাক হলেন। এত বড়ো একটা ব্যাপার তিনি ভুলেই বসে আছেন। উফ, কী ঝামেলাই না হয়েছিল। বরফে চারদিক ঢাকা। বেশির ভাগ ফ্লাস্তিাঘাটই বন্ধ। এর মধ্যে রাহেলার ব্যথা শুরু হল! এ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলেই হত, তা না, তিনি গাড়ি নিয়ে বের হলেন। ফিফটিস্থ স্ট্রীট থেকে উঠিয়ে নিলেন নিশানাথ বাবুকে। কী দুরবস্থা ভদ্রলোকের। ব্যাপার-ট্যাপার দেখে আনিস বলল সেই ঠাণ্ডাতেও তাঁর কপাল দিয়ে টপ-টপ করে ঘােম পড়ছে। রাহেলা এক বার বললেন, আমার মনে হচ্ছে গাড়িতেই কিছু একটা হয়ে যাবে। নিশানাথ বাবু বললেন, মা কালীর নাম নেন, চেঁচামেচি করবেন না। রাহেলা ধমকে উঠলেন, মা কালীর নাম নেব কেন, মা কালী আমার কে? এই সময় গাড়ি স্কিড করে খাদে পড়ে গেল। উহ, কী ভয়াবহ সময়ই না গিয়েছে!