প্রস্তুতি কি একটু সকাল-সকাল নিয়ে ফেলছি না?
উঁহু, রিটায়ার করবার টাইম হয়ে আসছে। বছর দুই আছে মাত্র।
নিশানাথ বাবু জার্মান সিলভারের ফুলদানি ছাড়াও একটা বড়ো আয়না কিনে ফেললেন। আয়নাটির দাম পড়ল তিন ডলার। স্ট্যানলি বারবার বলল, আয়নাটায় খুব জিতে গেলে। আমার স্ত্রী ইটালি থেকে ছ শ লীরা দিয়ে কিনেছিল।
তিনি বাড়ি ফিরলেন এগারটার দিকে। কী আশ্চর্য, রুনকি বসে আছে বারান্দার ইজিচেয়ারে! রুনকি হাসিমুখে বলল, গ্যারাজ-সেলে গিয়েছিলেন চাচা?
হুঁ।
ইশ, কী যে এক রোগ বাধিয়েছেন!
ভেতরে আয়, রুনকি।
আজ কী কিনলেন?
জার্মান সিলভারের একটা ফুলদানি, আর একটা আয়না। তুই নিবি?
না।
আয়নাটা নিয়ে যা! ভালো জিনিস, ছ শ লীরা দাম পড়েছে ইটালিতে।
পড়ুক। চাচা, আপনার কাছে বিদায় নিতে এলাম।
নিশানাথ বাবু কিছু বললেন না। চায়ের পানি চড়ালেন। রুনকি সোফায় বসতেবসতে বলল, আমরা মন্টানায় চলে যাচ্ছি।
মন্টানা খুব সুন্দর জায়গা।
আপনার সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না।
নিশানাথ বাবু দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, অল্পবয়েসী মেয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে কথা বললে ভালো লাগে না। তাদের বলা উচিত, আবার হয়তো দেখা হবে। অর্থ একই–আনসার্টিনিটি। কিন্তু বলার ভঙ্গিটা অপটিমিস্টিক। চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবি?
না চাচা। আপনাকে একটা খবর দিই, আমরা বিয়ে করছি।
জানি। শফিক বলেছে। বাঙালী কায়দায় নাকি বিয়ে হবে?
না, সে-রকম কিছু না।
নিশানাথবাবু চা বানিয়ে এনে দেখেন রুনকি কাঁদছে। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, কাঁদছিস কেন মা?
চাচা, আমি কি ভুল করছ?
কোনটা ভুল আর কোনটা নয়, তা বোঝা মানুষের সাধ্যের বাইরে। ও নিয়ে চিন্তা করিস না। চা খা।
রুনকি চায়ে চুমুক দিল। নিশানাথ বাবু গাঢ় স্বরে বললেন, খিদিরপুরের এক কলেজে অঙ্ক পড়াতাম, বুঝলি রুনকি। কী নিদারুণ অভাব গেছে আমার! আর এখন পাসবই দেখলে তুই চমকে উঠবি। আমি যদি খিদিরপুরে পড়ে থাকতাম, সেটা ভুল হত। আবার আমেরিকা আসাটাও ভুল হয়েছে। তাহলে ঠিক কোনটা?
রুনকি চুপ করে রইল। নিশানাথ বাবু বললেন, বেঁচে থাকার আনন্দটাই একমাত্র সত্যি। ঐটি থাকলেই হল। আয়নাটা একটা কাগজ দিয়ে বেঁধে দিই মা?
দিন।
নিশানাথ বাবু আয়নাটি গিফট র্যাপ করবার জন্যে পাশের ঘরে চলে গেলেন। রুনকি একটু হাসল। সে জানে, নিশানাথ বাবু শুধু আয়না কাগজ দিয়ে বাঁধবেন না। সেইসঙ্গে একটা খামের মধ্যে মোটা অঙ্কের একটা চেক থাকবে। এটি নিশানাথ বাবুর একটি পুরনো অভ্যাস। রুনকির সব জন্মদিনে তিনি রুনকিকে গল্পের বই দেন। সেই বইয়ের ভেতর একটা খাম থাকবেই; যা দেওয়ার তা সরাসরি দিয়ে দিলেই হয়, কিন্তু তা তিনি দেবেন না। কত রকম অদ্ভুত মানুষ দুনিয়াতে আছে!
মন ভেজানর সব চেষ্টা
জোসেফাইনের মন ভেজানর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বুড়ি পরিষ্কার বলে দিয়েছে, কাজ তোমাকে দেব না। মাথা-বেঠিক লোক আমি রাখি না। লুনাটিকদের বিষয়ে আমার এলাৰ্জি আছে।
আমাকে তো তাহলে না খেয়ে থাকতে হয় জোসেফাইনা! তুমি ছাড়া কে আমাকে কাজ দেবে? উপোস দিতে হবে। আমাকে।
একেবারে কিছুই না জুটলে এখানে এসে হামবার্গার খেয়ে যাবে, চার্জ লাগবে না। কিন্তু চাকরি তোমাকে দিচ্ছি না।
ফার্গোতে বিদেশীদের কাজ পাওয়া ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এ্যাড দেখে টেলিফোন করলেই জিজ্ঞেস করে।–গ্রীন কার্ড আছে? নেই শুনলেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখে। যারা কিছুটা ভদ্র, তারা মিষ্টি সুরে বলে, এখানে ওপেনিং নেই। তুমি ঠিকানা রেখে যাও, আমরা ওপেনিং হলে খবর দেব।
ওপেনিং নেই তো, এ্যাড দিলে কেন?
কয়েকটি ওপেনিং ছিল, সেগুলি ফিল্ড আপ!
দি মেঘনা রেস্টুরেন্টের জন্যে যে-টাকা পয়সা উঠেছে (সর্ব মোট সাত শ এগার ডলার), সেখানে হাত পড়েছে। রেস্টুরেন্টের চিন্তা এখন আর তেমন নেই। কারণ রহমান তার ইণ্ডিয়া হাইস নিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। তার ধারণা, এত ছোট শহরে বিদেশী রেস্তোর চলবে না। সে খোঁজ নিয়ে দেখেছে। এখানে যে কটি চীনা রেস্তোরা আছে, সেখানে শুক্র-শনি এই দু দিনই যা লোকজন হয়, অন্য দিন রেস্তোরা খা-খাঁ করে। তাছাড়া এই প্রচণ্ড শীতে কার এমন মাথাব্যথা যে, কাঁপতে কাঁপতে বাইরে খেতে আসবে?
এদিকে ইমিগ্রেশনের লোকজনও বেশ ঝামেলা করছে। তিন-চারটে চিঠি এসেছে, কোন দিন হুঁট করে হয়তো পুলিশ এসে হাজির হবে। ঠিকানা বদলাতে হল সেই কারণেই। নিক্স প্লেসের উল্টোদিকে ছোট একটা ঘর। শুধু শোয়ার ব্যবস্থা। খাওয়াদাওয়া নিক্স প্লেসে। বুড়ি তার কথা রেখেছে। খাওয়ার পর বিল দিতে গেলে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করে, কাজ পেয়েছ?
না।
নো চার্জ
বেশ, খাতায় লিখে রাখ, চাকরি পেলে সব একসঙ্গে দেব।
বাকির কারবার আমি করি না, ভাগো।
কাজ শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল।
ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের সেই চাকরি। গোটা দশেক বাঁদর, কয়েকটি কুকুর আর প্রায় শ দুয়েক গিনিপিগের দেখাশোনা। সময়মতো খাবারদাবার দেওয়া। খাঁচা পরিষ্কার করা। পশুগুলিকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত রাখা। কাজ অনেক, সেই তুলনায় বেতন অল্প। নব্বই ডলার প্রতি হপ্তায়। নব্বই ডলারই সই। মহা উৎসাহে কাজে লেগে গেল শফিক।
কাজটা যত খারাপ মনে হয়েছিল তত নয়। বাঁদরের খাঁচায় একটিকে পাওয়া গেল একেবারে শিশু। শফিককে দেখেই সে দাঁত বের করে ভেংচে দিল। শফিক অবাক!