রুনকি দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলতে পারল না।
তুমি কখন জানলে?
সেটা কি খুব ইম্পটেন্ট?
শ্যাম্পেনের মুখ খোলামাত্রই কৰ্কটি বহু দূর ছুটে গেল। টম হেসে বলল, আমার বাচ্চা খুব ভাগ্যবান হবে। আর শোন রুনকি, আমার মনে হয় আমাদের বিয়ে করা উচিত। ম্যারেজ লাইসেন্স এখান থেকেই নিয়ে যাব। হানিমুন হবে মন্টানায়, ঠিক আছে? না কি তুমি আনমেরিড মাদার হতে চাও?
রুনকি জবাব দিল না। টম বলল, তোমাকে বিয়ের পর আমার বাবা-মার কাছে নিয়ে যাব। সিয়াটলে থাকেন তাঁরা। তাঁদের ছোট্ট একটা ফার্ম আছে, তোমার ভালো লাগবে। তবে যেতে হবে গরমের সময়। তখন ওয়েদার ভালো থাকে। ওকি রুনকি,-কাঁদছ কেন?
মন্টানায় যাবার আগে রুমনকি দেখা করতে গেল মার সঙ্গে। রাহেলা দরজা খুলে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
কী মা, ঘরে ঢুকতে দেবে না?
রাহেলা কথা বললেন না, দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন।
বাবা কোথায়?
মেনিয়াপলিস গিয়েছে।
কবে ফিরবে?
সোমবার। ও, তাহলে আর দেখা হচ্ছে না। আমরা মন্টানা চলে যাচ্ছি, মা।
রাহেলা চুপ করে রইলেন। রুনকি ওভারকোট খুলতেই শান্ত স্বরে বললেন, মা হচ্ছ তাহলে?
হ্যাঁ হচ্ছি। তোমার এমন মুখ কালো করবার দরকার নেই মা। আমরা বিয়ে করছি। ম্যারেজ লাইসেন্স যোগাড় হয়েছে। বিয়েতে আসবে না জানি, তবু কার্ড পাঠাব।
রুনকি টাওয়াল দিয়ে মাথার চুল মুছল। হালকা গলায় বলল, কফি খাওয়াবে? যা ঠাণ্ডা বাইরে।
রাহেলা কফির পটি বসালেন। রান্নাঘর থেকেই থেমে থেমে বললেন, তোমার পড়াশোনার পাট তাহলে চুকেছে।
আবার শুরু করব। তাছাড়া—
তাছাড়া কি? পুঁথিগত পড়াশোনার তেমন দাম নেই মা! পৃথিবীতে যত টেলেন্টেড লোক জন্মেছে, তাদের কারোর ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি ছিল না।
তা ছিল না, কিন্তু ওদের টেলেন্ট ছিল। তোমার তা নেই।
রুনকি হাসল। কথার উত্তর না দিয়ে কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে চলে গোল দোতলায় তার নিজের ঘরে। ঘরটি রাহেলা চমৎকার করে সাজিয়ে রেখেছেন। দেখেই মনে হবে, এই বাড়ির মেয়েটি হয়তো কলেজে গিয়েছে, ফিরে আসবে এক্ষুণি।
রুনকি দেখল, তার ব্যবহৃত কাপড়গুলি পর্যন্ত ইস্ত্রি করে রাখা হয়েছে। বার্বি ডল দুটি মা নিচ থেকে নিয়ে এসে তার ঘরে রেখেছেন। দেয়ালে রুনকির ছোটবেলার একটি ছবি–বাবল গাম দিয়ে বল বানানর চেষ্টা করছে রুনকি।
রাহেলা শুনলেন উপরে গান বাজছে। কিং ষ্টোন ট্রায়োর বিখ্যাত গান,
We had joy we had fun
We had Seasons in the Sun
But the hills we will climb
Where the Seasons out of time
তিনি নিঃশব্দে উপরে উঠে এলেন। রুনকি কার্পেটে পা ছড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে। ক্লান্ত বিষণ্ণ একটি ভঙ্গি। কাঁদছে নাকি? রাহেলা বললেন, রুনকি, তুমি কি দুপুরে খাবে এখানে?
রুনকি চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, না মা, দুপুরে আমরা রওয়ানা হব। টম এসে এখান থেকে তুলে নেবে আমাকে।
তুমি যদি তোমার কোনো জিনিসপত্র নিতে চাও, নিতে পার।
মা, আমি কিছুই নিতে চাই না।
রুনকি চোখ মুছে বলল, তুমি কি আমার বাচ্চাটির জন্যে দুটি নাম দেবে? একটি ছেলের নাম, একটি মেয়ের নাম।
রাহেলা থেমে থেমে বললেন, আমার নাম তোমাদের পছন্দ হবে না রুনকি। তোমরা নিজেরা নাম বেছে নাও।
কেন তুমি এত রেগে আছ মা? তুমি কি বুঝতে পারছ না, আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি?
দূরে গেছ অনেক আগেই। নতুন করে বোঝাবুঝির কিছু নেই।
রুনকি রেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যাবার আগে পুরনো দিনের মতো তুমি কি আমাকে একটি চুমু খাবে, মা? প্লীজ।
নিশানাথ বাবু
নিশানাথ বাবু খুব সকালে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন।
উদ্দেশ্য আশেপাশের গ্যারাজ-সেলগুলি খুঁজে দেখা। প্রি-উইন্টার গ্যারাজসেল শুরু হয়েছে। বুড়ো-বুড়ির দল অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়ির গ্যারাজে সাজিয়ে বসে আছে। মূল্য নামমাত্র। নিশানাথ বাবু সকাল থেকেই এ সব দেখে বেড়াচ্ছেন। গ্যারাজ-সেলে ঘুরে বেড়ান। তাঁর বাতিকের মতো। যে—সব জিনিস তিনি গত চৌদ্দ বছরে কিনেছেন, তার মধ্যে একটি প্রকাণ্ড পিয়ানো পর্যন্ত আছে। এম স্ট্রীটের দুতলা বাড়ি গ্যারাজ-সেলে কেনা জঞ্জাল দিয়ে তিনি ভর্তি করে ফেলেছেন। নতুন কিছু কিনে রাখবার জায়গা নেই, তবু কিনছেন।
আজ তাঁর একটি ফুলদানি পছন্দ হল। জার্মান সিলভারের ফুলদানি। খুব সুন্দর কাজ। দাম লেখা আছে। এক ডলার।
এরচে কমে দিতে পার? এক ডলার বড্ড বেশি মনে হচ্ছে।
যে—বুড়ো জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে আছে, সে অবাক হয়ে বলল, এক ডলার কি যথেষ্ট কম নয়। ড. নিশানাথ?
নিশানাথ বাবু দেখলেন বুড়ো হচ্ছে স্টাটিসটিকসের স্ট্যানলি। মাংকি ক্যাপে সমস্ত মুখ ঢেকে রেখেছে বলে চেনা যাচ্ছে না।
গুড মনিং স্ট্যানলি।
গুড মনিং। কফি খাবে? গ্যারাজ-সেল উপলক্ষে কফি পাওয়া যাচ্ছে। পঞ্চাশ সেন্ট চার্জ, ফ্ৰী রিফিল।
নিশানাথ বাবু পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে এক পেয়ালা কফি নিলেন। বিক্রিটিক্রি কেমন?
মন্দ নয়, সাড়ে ন ডলার বিক্রি করেছি। বস তুমি, ঐ চেয়ারটাতে বস।
নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে স্ট্যানলির দিকে তাকালেন। এই লোকটি মাসে চার হাজার ডলারের মতো পায়। দুপুরের একটা সাদাসিধা লাঞ্চের জন্যেই খরচ করে ত্রিশ-চল্লিশ ডলার। অথচ সে বাড়ির যত সব জঞ্জাল সাজিয়ে সাড়ে ন ডলার বিক্রি করে কী খুশি!
স্ট্যানলি ভারি স্বরে বলল, ওলড হোমে যাবার প্রস্তুতি, বুঝলে। জিনিসপত্র সব বিক্রিটিক্রি করে হাত খালি করছি।