প্রকৃতির কাছে সম্পূৰ্ণ পরাজিত একটি শহরের ছবি আঁকব, তারপর বিদায়। বুঝলে রুনকি, এখনো সময় হয় নি।
পরাজিত হবার আর বাকি কোথায়?
অনেক বাকি। এখনো বাকি আছে।
এই এ্যাপার্টমেন্টটিতে রুনকির গা ঘিনঘিন করে। যে–মেয়েটির সঙ্গে রান্নাঘর ও বাথরুম শেয়ার করতে হয়, সে সবকিছু বড়ো ময়লা করে রাখে। গভীর গাত পর্যন্ত হাই ভল্যুমে গান শোনে। সময়ে-অসময়ে টমের কাছে সিগারেট চায়। ভালো লাগে না রুনকির। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। প্রায়ই এ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িতে মদ খেয়ে লোকজন গলা ফাটিয়ে চেঁচায়। কিছুদিন আগেই পুলিশ এসে ছ নম্বর ঘর থেকে একটি লোককে ধরে নিয়ে গেল। এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে পারলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যায়। কিন্তু যাবার উপায় নেই, এর চেয়ে সস্তায় ফার্গোতে এ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যাবে না। টম নিজেও অনেক খোঁজাখুজি করেছে। কিন্তু ওর হাত একেবারেই খালি। অবস্থা এরকম চললে আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটের জন্যে হাত পাততে হবে। টমের তাতে খুবই আপত্তি।
আমি কি ভিখিরি, যে আন-এমপ্লয়মেন্ট নেব?
যখন কিছুই থাকবে না, তখন কী করবে?
তখন অন্য কোথাও যাব। এই নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
কোনো কাজ-টাজ করে টমকে সাহায্য করার ইচ্ছা হয়। রুনকির, কিন্তু শীতের সময়টায় কাজ পাওয়া খুব মুশকিল। একটি কাজ পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ ফার্গোতে। গাড়ি ছাড়া অত দূর যাওয়ার কোনোই উপায় নেই। বাস ঐ লাইনে যায় না। টমের গাড়িও নেই। দিন-রাত ঘরেই বসে থাকতে হয় রুনকির। ইউনিভার্সিটির ক্লাস বাদ দিতে হয়েছে। উইন্টার কোয়ার্টারে নাম রেজিস্ট্রি করা হয় নি। ধারে সাত শ ডলার যোগাড় করা গেল না।
টম কাজের খোঁজে সারা দিন ঘোরাঘুরি করে। রুনকি ঘরেই থাকে। ভালো লাগে না। টম সেদিন বলল, তুমি বাবা-মার কাছে ফিরে যাও, রুনকি।
কেন?
তোমার এখানে আর মন লাগছে না।
আমি কি বলেছি, মন লাগছে না?
বলতে লজ্জা লাগছে বলে বলছ না। বাবা-মার কাছে ফিরে যেতেও তোমার লজ্জা লাগছে। লজ্জার কিছু নেই, রুনকি।
তুমি বড্ড বাজে কথা বল, টম।
টম হেসে বলেছে, এইটি তুমি ভুল বললে রুনকি। বাজে কথা আমি কখনে, বলি না। তোমার মধ্যে দ্বিধা দেখতে পাচ্ছি বলেই বলছি।
তোমার কি ধারণা, আমি আর তোমাকে ভালোবাসি না?
সে কথা আমি বলি নি, রুন।
তুমি কি আমাকে ভালোবাস?
তুমি খুব চমৎকার একটি মেয়ে। তোমাকে যে কেউ ভালোবাসবে।
তুমি কিন্তু আমার কথার জবাব দাও নি।
আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি রুনকি।
যদি সত্যি ভালোবাস, তাহলে,–প্লীজ, চল, অন্য কোথাও যাই।
আর কয়েকটা দিন, প্রকৃতির কাছে শহরের পরাজয়ের ছবিটা শেষ করেই রওনা হব।
রুনকির এখন মাঝেমাঝে ইচ্ছা করে মার সঙ্গে গিয়ে কথা বলে, কিন্তু সাহস হয় না। তার দিকে তাকিয়েই মা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলবেন ব্যাপারটা। মায়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে।
শফিক এসেছিল সেদিন। সে শুধু বলল, বাহ্, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে তোমার রুনকি।
রুনকি একবার ভাবলা, শফিককে বলবে ব্যাপারটা। কিন্তু বলতে-বলতেও সামলে গেল। টমকে আগে জানান উচিত। টমের আগে অন্য কারোর জানা ঠিক নয়।
শফিক এলেই অনেক খবর পাওয়া যায়। সমস্তই বাংলাদেশের খবর।
বুঝলে রুনকি, জিয়াউর রহমান সাহেবের নাম হয়েছে এখন জিয়াউর রহমান খাল কাটি। শুধুই খাল কাটছে।
জিয়াউর রহমান কে?
মাই গড! আমাদের প্রেসিডেন্ট। ফেরেশতা আদমি।
তাই নাকি?
বেচারার একটা হাফ শার্ট আর দুটো ট্রাউজার, আর কিছুই নেই।
কী যে তুমি বল শফিক ভাই।
এই তো, বিশ্বাস হল না। মিথ্যা বলব কেন খামাখা? একটা পয়সা বেতন নেয় না গভর্মেন্টের কাছ থেকে।
বেতন না নিলে চলে কী করে?
চলে আর কোথায়? কিছুই চলে না। দেশের জন্য লোকটার জান কবুল। নিজের দিকে তাকাবার সময় আছে?
শফিক এলে রুনকি কিছুতেই যেতে দেয় না। বাংলাদেশী রান্না রাঁধতে চেষ্টা করে। ভাত রান্না হয় সেদিন।
রানা কেমন হয়েছে শফিক ভাই? মার মতো হয়েছে?
চমৎকার! ফাস ক্লাস।
ভাতটা বেশি নরম হয়ে গেছে, না?
নরমই আমার কাছে ভালো লাগে। চাবানর দরকার হয় না। মুখে ফেললেই হড়হড় করে নেমে যায়।
চাকরি পেয়েছ শফিক ভাই?
না। জোসেফাইনকে খুব তেলাচ্ছি, কাজ হচ্ছে না।
অন্য কোথাও চেষ্টা কর।
গ্ৰীন কার্ড নেই, কাজ দেবে কে আমাকে? গভীর সমুদ্র।
সেবার যে বলেছিলে ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টে একটা কাজ পাবে?
সম্ভাবনা চল্লিশ পার্সেন্ট। বাঁদরের দেখাশোনা। খাঁচা পরিষ্কার রাখা। ওদের ব্যালেন্সড ডায়েট দেওয়া। ড. লুইসের হাতেই সব, দেখি ব্যাটাকে ভজনা যায় কিনা। শালার দয়া-মায়া কিছুই নেই শরীরে। দুঃখের কথা বলেও লাভ হয় না।
পরাজিত শহরের ছবি টমের আঁকা হল না। মন্টনার ছোট্ট একটি শহরে কাজ পাওয়া গেল। এক ভদ্রলোক পাহাড়ের ওপর চমৎকার একটি শীতাবাস বানিয়েছেন, তার লবির ডেকোরেশন। কাজটি লোভনীয়। কারণ, যত দিন কাজ শেষ না হচ্ছে, তত দিন শীতাবাসে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। পাশেই স্কী করবার স্পট। জমে-যাওয়া একটি হ্রদ আছে। সেখানে উইন্টার ফিশিং-এর ব্যবস্থা আছে। বরফ খুড়ে ছিপ ফেললেই প্রকাণ্ড সব কার্প ধরা পড়ে। টম রাজি হয়ে গেল। পরাজিত শহরের ছবি পরেও আঁকা যাবে। রুনকিকে অবাক করে দিয়ে এক সন্ধ্যায় শ্যাম্পেনের একটি বোতল নিয়ে এল।
এস রুনকি, সেলিব্রেট করা যাক।
কিসের সেলিব্রেশন?
তোমার বাচ্চা আসছে, সেই সেলিব্রেশন।