রুনকি বহু কষ্টে হাসি সামলায়।
টম বুঝি রাজি হবে! তোমার যে কি সব চিন্তাভাবনা শফিক ভাই!
রাজি হবে না মানে? টমের ঘাড় রাজি হবে। ব্যাটা দেশের একটা বেইজ্জতী করে ফেলেছে। বাংলাদেশী মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে…
রুনকি গম্ভীর মুখে বলল, শফিক ভাই, টম কাউকে ভাগিয়েটাগিয়ে আনে নি। আমি নিজেই এসেছি। আর আমার জন্যে তোমার বাংলাদেশের কোনো বেইজ্জতী হয় নি। আমি বাংলাদেশী নই। আমি বাই বাৰ্থ আমেরিকান। আমার বাবা-মার মতো নেচারালাইজড সিটিজন না।
শফিক সারা দিন থাকল রুনকির ওখানে! দি মেঘনা রেস্টুরেন্ট খোলার ব্যাপারে তার রুনকির সাহায্য দরকার। হুলস্থূল কাণ্ড করতে হবে সেখানে। লাঞ্চ ও ডিনারের টাইমে পল্লীগীতির সুর বাজবে। বাংলাদেশের বিখ্যাত সব শিল্পীদের তেলরঙের নিসর্গ-দৃশ্যের ছবি দিয়ে সাজান হবে লবি। খাওয়ার শেষে হাতে তুলে দেওয়া হবে এক খিলি পান এবং খাঁটি বাংলায় বলা হবে–আবার আসবেন।
কিন্তু–টাকাটা তুমি পাচ্ছ কোথায়?
সবার কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে যোগাড় হবে। তোমাকেও দিতে হবে। ছাড়াছড়ি নাই।
আমার কাছে আছেই কুল্যে এক শ ডলার।
দাও, এক শ ডলারই সই। তোমাকে দিয়েই শুরু।
সারা দিন অপেক্ষা করেও টমের দেখা পাওয়া গেল না। সে আসবে রাত আটটায়। রুজভেল্ট স্কুলের কী-একটা ডেকোরেশনের কাজ নাকি পেয়েছে। শেষ করে ফিরবে।
অক্টোবর মাস
অক্টোবর মাস। বরফ পড়ার সময় নয়, কিন্তু আবহাওয়া অফিস বলেছে তুষারপাত হতে পারে। সম্ভাবনা শতকরা বিশ ভাগ। আকাশ অবশ্যি পরিষ্কার। ঝকঝকে রোদ। সন্ধ্যার আগে আগে দেখা গেল সব ঘোলাটে হয়ে আসছে। সাড়ে ছটা থেকে ঝুরঝুর করে বরফ পড়তে শুরু করল। বৎসরের প্রথম বরফ, খুশির ঢেউ খেলে গেল চারদিকে। ছেলে-বুড়ো সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে বলছে–আহ! কী চমৎকার তুষার পড়ছে। হাউ লাভলি!
রাত নটার খবরে বলল–কানাডা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে আর উষ্ণ হওয়া আসছে সাউথ থেকে, কাজেই সারা রাত ধরে ব্লিজার্ড হতে পারে। ইতোমধ্যে এক ফুটের মতো বরফ পড়েছে। রাস্তা ঘাট পিছল। কেউ যেন বিনা প্রয়োজনে বাইরে না। যায়। হাইওয়ে আই নাইন্টি বন্ধ। বড়োই ফুর্তির সময় এখন। শুরু হবে ব্লিজার্ড পাটি। উপকরণ সামান্য–বিদ্যার, বাদাম ভাজা এবং চড়া মিউজিক। বৎসরের প্রথম ব্লিজার্ডকে স্বাগত জানানরা এই হচ্ছে ফার্গোর সনাতন পদ্ধতি।
আনিস মোটা একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে সোফায় আরাম করে বসল। ঘরে একটি ফায়ারপ্লেস আছে। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালানির কায়দা-কানুন তার ভালো জানা নেই। চিমনি পরিষ্কার আছে কিনা কে জানে। এর চেয়ে কম্বল জড়িয়ে থাকাই ভালো। কফি-পটে কফি, গরম হচ্ছে। টিভিতে দেখাচ্ছে ডেভিড কপারফিন্ডের ম্যাজিক। হাতের কাছে দুটি রগরগে ভূতের বই। একটি ষ্টিফান কিংয়ের সাইনিং। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে কোনো সুস্থ লোক এই বই একাএকা পড়তে পারবে না। অন্যটি ডিমস কিলেনের দি আদার নুন। পিশাচ নিয়ে লেখা রক্ত-জল—করা উপন্যাস। রিজার্ডের রাতের জন্যে এর চেয়ে ভালো প্রস্তুতি কল্পনাও করা যায় না।
আনিস জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। বরফে সমস্ত ঢেকে গেছে। বাতাসের সঙ্গে উড়ছে বরফের কণা। গাছের পাতায় মাখনের মতো থরে থরে তুষার জমতে শুরু করেছে। একটি ধবধবে সাদা রঙের প্রকাণ্ড চাদর যেন ঢেকে ফেলেছে। শহরটিকে। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সাদা চাদর নৌকার পালের মতো কাঁপছে তিরতির করে। অপূর্ব দৃশ্য! চোখ ফেরান যায় না। আনিস মন্ত্রমুগ্ধের মতো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মালিশা গিলবার্ড এসে উপস্থিত হল এই সময়।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতেও তার গায়ে পাতলা একটা উইণ্ড ব্রেকার ছাড়া আর কিছুই নেই। কালো একটা স্কাফে কান দুটি ঢাকা। হাতে খাবারের একটি প্যাকেট। মালিশা বলল, আমি ভাবলাম কেউ নেই। অনেকক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি, ঘরে তোমার বান্ধবীরা কেউ আছে বুঝি?
আনিস বলল, ভেতরে এস। এ রকম দিনে বেরুলে কী জন্যে?
মালিশা বলল, তুমি কথার জবাব দাও নি। ঘরে কি তোমার বান্ধবীরা কেউ আছে?
না, তা নেই।
যাক, আমি শুধু দু জনের জন্যে খাবার এনেছি।
মালিশ খানিকটা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে প্যাকেট খুলতে শুরু করল।
আনিস বলল, স্কার্ফটা খুলে মাথা মুছে নাও। এত তাড়া কিসের মালিশা?
তাড়া আছে। দুপুরে খাই নি কিছু। খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে আছে। গরম করতে দিয়ে তারপর হাত মুখ ধোব।
খাবার বিশেষ কিছু নয়। বড়ো একটি প্যান পিজা, কয়েকটি মেক্সিকান টেকো এবং এক বোতল সস্তা বারগাণ্ডি।
আনিস বলল, কোনো বিশেষ উপলক্ষ আছে কি মালিশা?
আজ আমার জন্মদিন।
আনিস হাসিমুখে বলল, দু মাস আগে এক বার তুমি জন্মদিনের খাবার খাইয়েছি।
ঐ দিন মিথ্যা বলেছিলাম। তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। জন্মদিনের অজুহাত দিয়ে নিয়ে গেলাম।
এমনি বললে বুঝি যেতাম না?
না। আমি ভালো মেয়ে নই। আমার সঙ্গে বেরুতে হয়তো তোমার সংকোচ হত।
মালিশ দ্রুত হাতে খাবার ওভেনে ঢুকিয়ে মাথার চুল মুছতে শুরু করল।
হঠাৎ করে এসেছি বলে রাগ কর নি তো? টেলিফোন করব ভেবেছিলাম। পরে ভাবলাম টেলিফোনে তুমি বলে বসতে পোর।–আমি ব্যস্ত। সামনাসামনি কেউ এমন কথা বলতে পারবে না। আনিস, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছে?
বিরক্ত হব কেন? কিন্তু জন্মদিনের কেক কোথায়?
কেক কেনা গেল না। টাকা কম পড়ে গেল, তাছাড়া কেক আমার ভালোও লাগে না।