ভদ্রমহিলা স্তম্ভিত।
ভয় নেই, পছন্দ না হলে নগদ দাম দেব। দেখ ভালো করে।
সন্ধ্যাবেলার ছবি। পুরনো ধরনের একটি লাল রঙ ইটের বাড়ির ভাঙা জানালা দিয়ে একটি কিশোরী মেয়ে উঁকি দিচ্ছে। মেয়েটির চোখে-মুখে সূর্যের রক্তিম আলো। ছবি থেকে চোখ ফেরান মুশকিল। ভদ্রমহিলা আমতা আমতা করতে লাগলেন।
আমার হাসবেণ্ডের সঙ্গে কথা না বলে তো রাখতে পারি না।
বেশ, তাহলে নগদ দাম দিচ্ছি। টম গম্ভীর মুখে পকেটে হাত রাখল। (পকেটে একটি মাত্র পঞ্চাশ ডলারের নোট)। ভদ্রমহিলা থেমে থেমে বলল, তার চেয়ে এক কাজ কর, ছবিটা রেখে যাও। আমি ওর সঙ্গে আলোচনা করে তোমাকে জানাব!
বেশ তো, বেশ তো।
টম জানে এই মেয়েটির স্বামীকে ছবিটি রাখতেই হবে। অবশ্য একটি ভালো ছবি হাতছাড়া হল। তাতে কিছুই আসে যায় না। কাউকেই ধরে রাখা যায় না। সমস্তই হাতছাড়া হয়ে যায়।
রুনকি যখন প্রথম উঠে এল টমের ঘরে, তখন টম সিরামিক্সে কিছু ফ্যান্সি পেইন্ট করছিল। দশটি টবের অর্ডার আছে, বিকেল পাঁচটার মধ্যে দিতে হবে। সময় লাগছে খুব বেশি। রুনকিকে ঢুকতে দেখে টম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, কিছু বলল না। রুনকি বলল, তোমার সঙ্গে থাকতে এলাম টম।
বেশ তো, ভালো করেছ।
টম ছবি আকায় মন দিল। নীল রঙটা ঠিক মানাচ্ছে না, কেমন যেন লেপ্টে লেপ্টে যাচ্ছে। রুনকি গম্ভীর হয়ে বলল, আমি বাবা-মা সবাইকে ছেড়ে এসেছি। তুমি বোধ হয় ঠিক বুঝতে পারছ না।
টম ডিজাইন থেকে চোখ তুলেই বলল, বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে থাকতে আসাটা ঠিক হত না। আমি বুড়ো-বুড়ি সহ্য করতে পারি না।
তুমি মন দিয়ে শুনছ না টম। দয়া করে শোন আমি কী বলছি। তাকাও আমার দিকে। প্লীজ।
টম তাকাল।
আমি তোমার জন্যে সব ছেড়েছুড়ে এসেছি।
রুন, এটি তুমি ভুল বললে। তুমি আমার জন্যে আস নি। এসেছ নিজের জন্যে। আমি তোমকে কখনো আসতে বলি নি। মনের মধ্যে এসব ভুল ধারণা থাকা ঠিক না। এতে পরে কষ্ট পাবে।
রুনকি জবাব দিল না। টম বলল, চট করে কফি বানিয়ে আন তো দেখি আমার জন্যে। চিনি দু চামচ চাই, নো ক্রীম। বাইরে থেকে টমকে ভবঘুরে ও ছন্নছাড়া মনে হলেও আসলে সে মোটেও সে-রকম নয়। রুনকি অবাক হয়ে দেখল, টমের অত্যন্ত গোছোল স্বভাব। সিগারেট খেয়ে ঘরময় ছড়িয়ে রাখে না। হৈ-চৈ হুঁল্লোড় কিছুই করে না। রুনকির ঘুম ভাঙার আগেই সে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফার্স্ট তৈরি করে ছবি নিয়ে বসে। ঘণ্টা তিনেক একনাগাড়ে কাজ করে। এই সময় তার মূর্তি ধ্যানী পুরুষের মূর্তি। কথা বললে জবাব দেবে না। চা খাবে না, সিগারেট খাবে। সকালের কাজ শেষ হলেই ঘণ্টাখানেক শুয়ে থাকবে চুপচাপ। তার ভাষায় এটি হচ্ছে মেডিটেশন। বারোটা নাগাদ লাঞ্চ তৈরী হবে। লাঞ্চ শেষ করেই বেরুবে কাজের খোঁজে। সব দিন কাজ পাওয়া যায় না। ঘোরাঘুরিই সার। তখন সে তার আঁকা চমৎকার একটি ছবি রাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে বসে থাকবে। ছবির নিচে বড়ো বড়ো হরফে লেখা–এক জন দুরারোগ্য ক্যানসারে মরণাপন্ন শিল্পীকে সাহায্যের জন্যে ছবিটি কিনুন। এই শিল্পী গোগ্যাঁর মতো ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন, কিন্তু হয়, ভাগ্যের কী ছলনা! ছবি বিক্রি হয়ে যায় চট করে। যে-কোনো ছবি বিক্রি হলেই টমের খানিক মন খারাপ হয়। বিড়বিড় করে নিজের মনে–কিছুই ধরে রাখা যাচ্ছে না। কোনো-কোনো দিন মনখারাপের তীব্রতা এতই বাড়ে যে, সে হুইঙ্কি খেতে খেতে চোখ লাল করে বাড়ি ফেরে। রুনকিকে গম্ভীর হয়ে বলে প্রচুর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলাম, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। লাল হচ্ছে আমার সবচে ফেবারিট কালার, অথচ লাল রঙের ব্যবহারটা এখনো শিখতে পারলাম না। এরকম জীবনের কোনো মানে হয়?
এই জাতীয় কথাবার্তার কোনো অর্থ হয় না, বলাই বাহুল্য। তবু রুনকির ভয় করে। বড়ো শিল্পী না হওয়াই ভালো। টম আর দশ জন মানুষের মতো সহজ স্বাভাবিক মানুষ হোক। সংসারে ভালোবাসা থাকুক, সুখ থাকুক। খ্যাতির কি সত্যি কোনো প্রয়োজন আছে?
টম অবশ্যি রুনকিকে খুবই পছন্দ করে। তবু রুনকির ভয় কাটে না। সব সময় মনে হয়, এক দিন সে হয়তো ভালোমানুষের মতো ঘর থেকে বেরুবে, আর ফিরবে না। পৃথিবীতে এক ধরনের মানুষ আছে যাদের ভালোবাসা দিয়ে ধরে রাখা যায় না।
রুনকি নিজেকে মানিয়ে নিল খুব সহজেই। বাজার করা, রানা করা।–কোনো কিছুই আর আগের মতো জটিল মনে হল না তার কাছে। বাইরে বেরুলে একটি ক্ষীণ অস্বস্তি অবশ্যি থাকে মনের মধ্যে।–যদি পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয়? সবচে ভালো হত যদি টমকে নিয়ে বহু দূরে কোথাও চলে যাওয়া যেত। প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট কোনো একটা দ্বীপে। যেখানে জনমানুষ নেই। সারাক্ষণ হুঁ-হুঁ করে হাওয়া বইছে। সন্ধ্যাবেলা আকাশ লাল করে সূর্য ড়ুবে হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়।
টমের এই বাড়িটিও অবশ্যি দ্বীপের মতোই। শহরের বাইরে খোলামেলা একটা বাড়ি। কেউ ঠিকানা জানে না বলেই কেউ আসে না। রুনকি মাকে টেলিফোন করে ঠিকানা দিতে চেয়েছিল। রাহেলা শান্ত স্বরে বলেছেন, তোমার ঠিকানার আমার কোনো প্রয়োজন নেই রুনকি। তোমার ঠিকানা তোমার কাছেই থাকুক।
ঠিকানা না রাখলে টেলিফোন নাম্বার রাখ।
রাহেলা উত্তর না দিয়ে টেলিফোন নামিয়ে রেখেছেন। কেউ জানে না রুনকি কোথায় আছে, তবু এক দিন শফিক তার ভাঙা ডজ গাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত। রুনকির বিস্ময়ের সীমা রইল না। শফিক গাড়ি থেকে নেমেই বলল, বাংলাদেশী কায়দায় তোমাদের একটা বিয়ের ব্যবস্থা করবার জন্যে এলাম। গায়ে হলুদ-টলুদ সব হবে। বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িতে রুই মাছ যাবে।–গায়ে হলুদের তত্ত্ব। দেশের একটা পারলিসিটি হয়ে যাবে। মেলা লোকজনকে বলা হবে, কি বল?