আমি জানি। মেয়েটির নাম নিশ্চয়ই মালিশা। ঠিক না?
আনিসা জবাব দিল না।
জোসেফাইন পঞ্চম বারের মতো শফিকের চাকরি নট করে দিল।
তোমার মতো মিনমিনে শয়তান, ফাজিল আর অকর্মাকে ছাড়াও আমার চলবে। শুক্রবারে এসে পাওনা-গণ্ডা বুঝে নেবে।
বুড়ির রেগে যাওয়ার কারণ, শফিক এক জন কাস্টমারের নাকে গদাম করে ঘুষি মেরেছে। বেচারার দোষ হচ্ছে, সে নাকি শফিকের দেশ বাংলাদেশ শুনে কোমরে হাত দিয়ে হায়নার মতো হোসেছে। জোসেফাইন চোখ লাল করে বলেছে, হেসেছে বলেই ঘুষি মারবো? খুশি হয়ে বেচারা হোসেছে।
খুশি হয়ে হেসেছে মানে? এই হাসি খুশি হওয়ার হাসি?
কিসের হাসি সেটা? বল তুমি কিসের হাসি?
কিসের যে হাসি তা অবশ্যি শফিকও জানে না। হয়তো বিনা কারণে হোসেছে। কিন্তু শফিকের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ যাচ্ছিল। সকালবেলাতেই খবর পাওয়া গেছে জেমসটাউনের রকিবউদ্দিন একটি রেস্টুরেন্ট দিচ্ছে। মন খারাপ করার মতো খবর নয়। কিন্তু রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছে ইণ্ডিয়া হাউস। শফিককে টেলিফোন করে বলল, বাংলাদেশের নাম তো কেউ জানে না। কিন্তু ইণ্ডিয়ান ফুডের নাম জগৎজোড়া, কাজেই নাম দিলাম ইণ্ডিয়া হাউস। আপনি ভাই ফার্গোর সব বাঙালিদের খবর দেবেন। ইনশাআল্লাহু আগামী মাসেই খুলব।
শফিক মেঘস্বরে বলল, ইণ্ডিয়া হাউস নাম দিয়েছেন?
এখনো ফাইন্যাল করি নি। ইণ্ডিয়া ফুডস-ও দিতে পারি।
অর্থাৎ ইণ্ডিয়া থাকবেই?
হ্যাঁ, তা তো থাকতেই হবে।
শোনেন ভাই, আপনাকে যদি আমি ফার্গোতে দেখি, তাহলে আপনাকে আমি খুন করে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসব, বুঝেছেন?
আপনি কী বলছেন, বুঝতে পারছি না।
চুপ শালা।
শফিক টেলিফোন রেখে নিক্স প্লেসে এসেই কাস্টমারের নাকে ঘুষি বসাল। জোসেফাইন এবার সত্যি সত্যি রেগেছে। এ পর্যন্ত তিন বার বলেছে।
শফিক তোমাকে যেন আর না দেখি। যথেষ্ট হয়েছে।
শফিক নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখে, ইমিগ্রেশন থেকে চিঠি এসেছে সে যেন চিঠি পাওয়ার সাত দিনের ভেতর ইমিগ্রেশন এ্যাণ্ড ন্যাচারলাইজেশন অফিসার টি, রবাটসনের সঙ্গে দেখা করে।
শফিককে এ নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হল না। তার মাথায় ঘুরছে, কী করে হারামজাদা রহমানকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। একটা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট দিয়ে ফেললে কেমন হয়? খুব কি কঠিন ব্যাপার? নাম দেওয়া যেতে পারে দি মেঘনা-এ প্লেস ফর এক্সোটিক বাংলাদেশী ফুড। কিন্তু ফুড কি এক্সোটিক হবে? শব্দটা ঠিক আছে নাকি? এইসব ব্যাপারে রুনকি এক জন ছোটখাটো বিশেষজ্ঞ। শফিক টেলিফোন করল তৎক্ষণাৎ। টেলিফোন ধরলেন রাহেলা।
আমি শফিক।
বুঝতে পারছি। কী ব্যাপার?
খালা, আমরা একটা রেস্টুরেন্ট দিচ্ছি, নাম হচ্ছে আপনার–দি মেঘনা।
কী দিচ্ছ?
রেস্টুরেন্ট। বাংলাদেশী সব খাবারটাবার পাওয়া যাবে। আজ সন্ধ্যায় বাসায় এসে সব আলাপ করব। রাহেলা গম্ভীর গলায় বললেন, সন্ধ্যাবেলা আমরা থাকব না।
ও আচ্ছা, রুনর্কিকে একটু দিন। ওর সঙ্গে কথা বলি।
রুনকি তো নেই।
নেই মানে?
রাহেলা থেমে থেমে বললেন, তুমি কি কিছু জান না?
না, কী জানব?
রুনকি এখন আর আমাদের সঙ্গে থাকে না।
কোথায় থাকে তাহলে?
রাহেলা ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, আমি জানি না কোথায় থাকে।
শফিক অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, কই, আমাকে তো কিছু বলেন নি।
তোমাকে বলতে হবে কেন? তুমি কে?
রাহেলা টেলিফোন নামিয়ে রেখে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠলেন। এই শহরে আর থাকতে পারবেন না। অনেক দূরে চলে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে আড়ালে, যাতে কেউ কখনো রুনকির খোঁজে টেলিফোন করতে না পারে।
রুনকি এণ্ড টম
রুনকি গিয়ে উঠেছে টমের ওখানে।
দুটি অবিবাহিত ছেলেমেয়ের একসঙ্গে বাস করা এমন কিছু অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। বিয়ের মতো এমন একটি প্রাচীন ব্যবস্থা কি আর এত সময় পর্যন্ত ধরে রাখা যায়? এখন হচ্ছে লিভিং টুগেদার। যত দিন ইচ্ছে একসঙ্গে থাকা, যখন আর ভালো লাগছে না, তখন দূরে সরে যাওয়া। কারো কোনো দায়িত্ব নেই। দায়িত্ব থাকলেই ভালোবাসা শিকলে আটকে যায়। শিকলে কি আর মায়াবী পাখি ধরা পড়ে?
টম যেখানে থাকে সেটি কোনো এ্যাপার্টমেন্ট নয়। চমৎকার একটি বাড়ি। সামনে লন আছে, ফুলের বাগান আছে, পেছনে চমৎকার সুইমিং পুল। বাড়ির মালিক এক মাসের জন্যে যাচ্ছে সুইজারল্যাণ্ড। সে-জন্যে সে বাড়িটা চার মাসের জন্যে ভাড়া দিতে চায়। ভাড়া নামমাত্র, মাসে চার শ ডলার। সবটা টাকা একসঙ্গে দিতে হবে।
টমের বাড়ি পছন্দ হয়ে গেল। রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি, পছন্দ না হয়ে উপায় আছে?
আমি নেব তোমার বাড়ি।
টমের পোশাক-আশাক দেখে বাড়ির মালিক ঠিক ভরসা পায় না। গম্ভীর হয়ে বলে, ষোল শ ডলার একসঙ্গে দিতে হবে কিন্তু।
বেশ তো, নিয়ে আসব বিকেলে। তুমি ঘরে থাকবে তো?
যেহেতু বিকেলে গেলে ভদ্রলোককে ঘরে পাওয়া যাবে, সেহেতু টম আর বিকেলে গেল না। পরদিন দুপুরে গিয়ে হাজির। ভদ্রলোক ঘরে নেই, তার স্ত্রী দরজা খুলল। টম হাসিমুখে বলল, আমি তোমার বাড়ি ভাড়া করতে এসেছি। তোমার স্বামীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
ও হ্যাঁ, তোমার জন্যে সে অপেক্ষা করছিল। তুমি কি ষোল শ ডলার নিয়ে এসেছে?
নিয়ে এসেছি।
টম কাঁধের ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া একটি পেইনটিং বের করল। গম্ভীর মুখে বলল, এর দাম কম করে হলেও তিন হাজার ডলার, তোমাকে জলের দামে দিচ্ছি।