না, না ঠিক আছে, বিশ্বাস হচ্ছে তোমার কথা।
তাছাড়া আমার নাকটাও বেশি ভালো না। মনে হয় অনেকখানি ঝুলো আছে। তাই না?
আমার তো মনে হয় না।
তোমার সৌন্দর্যবোধ নেই, তাই বুঝতে পারছি না।–নাকটা অল্প একটু তুলে দিলেই সব বদলে যাবে।
কেমন বদলাবে?
যেমন ধর, তখন যদি তোমাকে বলি–ব্রা খুললেই দেখবে আমার বুক দুটি টাইনি, তুমি দেখতে চাও? তুমি বলবে–তাই নাকি? কই দেখি তো?
আনিস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মালিশা, তুমি বেশ বুদ্ধিমতী!
আমার মায়েরও তাই ধারণা। মা বলেন–বুড়ো বয়সে কোনো ধনী মহিলার উচিত নয় তার মেয়েকে কাছে রাখা, বিশেষ করে সে মেয়ে যদি আমার মতো ইন্টেলিজেন্ট হয়।
কফি কেমন হয়েছে মালিশা?
ভালো।
আরেক কাপ নেবে?
দাও। তোমার নাম কিন্তু আমি জানি না।
আনিস।
তুমি কি ইণ্ডিয়ান?
না, বাংলাদেশ হচ্ছে আমার দেশ।
সেটা আবার কোথায়?
ইণ্ডিয়ার পাশে ছোট একটা দেশ।
সেখানেও কি ইণ্ডিয়ার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ থালা হাতে খাবারের জন্যে ঘুরে বেড়ায়?
কোথায় শুনেছ এসব?
আগে বল সত্যি কিনা। ডাস্টবিনের পাশে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বসে। থাকে।–কখন কেউ এসে খাবার ফেলবে সেই আশায়। বল, সত্যি নয়? নাকি তোমার স্বীকার করতে লজ্জা লাগছে?
আনিস ইতস্তত করে বলল, সত্যি নয়। বড়ো বড়ো অভাব হয়েছে। সে তো পৃথিবীর সব দেশেই হয়েছে। ইউরোপে হয় নি? আমেরিকাতেও তো ডিপ্রেসন হয়েছে।
আনিস, তুমি রেগে যাও কেন? তোমাকে রাগাবার জন্যে আমি বলি নি।
তোমরা যা ভাব, দেশটি মোটেই সে-রকম নয়।
মালিশা ঠোঁট চেপে হাসল। পরমুহুর্তে ভালোমানুষের মতো বলল, ইলেকট্রিসিটি আছে?
এসব জিজ্ঞেস করছ কেন?
কারণ, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছা না হলে বলবে না।
আনিস গম্ভীর মুখে বলল, না মালিশা, ইলেকট্রিসিটি-ফিটি নেই। গাড়ি ফাড়িও নেই। শহরে বাস সার্ভিসের বদলে আছে এলিফ্যান্ট সার্ভিস। হাতির পিঠে চড়ে যাওয়া-আসা।
ঠাট্টা করছ?
তা করছি।
কেউ আমার সঙ্গে ঠাট্টা করলে আমার ভালো লাগে না। প্লীজ, আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবে না এবং আমি সরি।
সরি কী জন্যে?
তোমাদের দেশের কথা বলে হার্ট করেছি, সেই জন্যে। আমার যখন টাকা হবে, তখন আমি তোমার দেশ দেখতে যাব।
বেশ তো।
দেশে তোমার কি বউ আছে?
না।
কোনো সুইটহার্ট?
না, তাও নেই।
আমি মনে মনে আশা করছিলাম, তুমি বলবে না। বিবাহিত লোকদের আমার ভালো লাগে না।
টুনটুন করে ঘণ্টা বাজছে। যে এসেছে, সে যদিও ডোরবেল বাজাচ্ছে, তবু লোকটি অপরিচিত। এরকম করে ঘণ্টা কেউ বাজায় না। ছোট বাচ্চাদের মতো অনবরত টিপেই যাচ্ছে! আনিস দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। নিশানাথ বাবু।
নিশানাথ বাবু ঢুকেই মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, এই মেয়েটি বড়ো সুন্দর তো! দূৰ্গা প্রতিমার মতো চোখ।
মালিশা বলল, আপনি কি আমাকে নিয়ে কিছু বলছেন? আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, তাই জিজ্ঞেস করছি।
নিশানাথ বাবু হাসিমুখে বললেন, আমি বলছি এই মেয়েটি কে? আমাদের এক গডেস-এর চোখের মতো অপূর্ব চোখ!
মালিশা হাসিমুখে বলল, আমার নাম মালিশা। আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে আপনি কি আমার সঙ্গে দয়া করে ডিনার খাবেন?
খাব না কেন?
নিশানাথ বাবুর ভাব দেখে মনে হল, তিনি খুব অবাক হয়েছেন প্রশ্ন শুনে।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে কিন্তু মাত্র চল্লিশ ডলার আছে। মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে গেলে মনে হয়। এতেই তিন জনের হয়ে যাবে, কি বলেন?
টেকো খেতে আর কয় পয়সা লাগবে? হয়েও থাকবে, দেখবে।
নিশানাথ বাবু ঠিকানা যোগাড় করে কী জন্যে হঠাৎ এসেছেন, আনিস বুঝতে পারল না। নিশানাথ বাবু ফার্গোতে এসেছিলেন বাংলাদেশের স্টল দেখতে। সেখান থেকে আনিসের কাছে এসেছেন। কারণ রেহানা বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন আনিসের ঘর হয়ে আসতে। হঠাৎ করে আনিসের সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে কেন, নিশানাথ বাবু বুঝতে পারেন নি। অনেক কিছুই তিনি বুঝতে পারেন না। আসতে বলা হয়েছে, তিনি এসেছেন। ব্যস।
আনিস বলল, বাংলাদেশের স্টল কেমন দেখলেন?
চমৎকার। ঐ টম ছোকরা কী সব কায়দাকানুন করে দিয়েছে, আমি স্তম্ভিত। টেবিলটাতে হার্ডবোর্ড-ফোর্ড লাগিয়ে রং-টাং দিয়ে এমন করেছে, দেখে মনে হয় একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ছোকরার গুণ আছে।
মালিশা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, আপনার নামটা কি দয়া করে বলবেন?
আমার নাম নিশানাথ।
এই নামের মানে কি?
এর মানে হল গড অব দ্য ডার্কনেস।
বাহ্, মজার নাম তো!
নিশানাথ বাবু সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ঐ টম ছোকরার গুণ আছে। হুলস্থূল করছে, বুঝলেন নাকি আনিস সাহেব। পেছনে হার্ডবোর্ডের উপর বৃষ্টির ছবি এঁকেছে। ছবির দিকে তাকালেই বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যায়। মনে হয় ব্যাঙ ডাকছে চারদিকে।
মলিশা বলল, ব্যাঙ ডাকছে মানে?
আমাদের দেশে বৃষ্টি হলেই ব্যাঙ ডাকে। সেই শব্দ জগতের মধুরতম ধ্বনির একটি। তুমি না শুনলে বুঝতে পারবে না।
ব্যাঙের ডাক তো আমি শুনেছি। ওর মধ্যে মধুরতর কী আছে? এই সব আপনি কী বলছেন?
মালিশা, তোমাকে বোঝান যাবে না।
নিশানাথ বাবু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মালিশা অবাক হয়ে বলল, আপনি অদ্ভুত লোক! সত্যি অদ্ভুত!
মালিশার বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল।
মেটোপলিটন বাসে উঠতে গিয়ে দেখে একটার উপর বাজে। ফাঁকা বাস। সে ছাড়া অন্য কেউ নেই। একটি নব্বুই বছরের বুড়ি ছিল, সে টুয়েলভ স্ট্রীটে নেমে গেল। নামবার সময় বুড়িটি বলল, আমাকে একটু হাত ধরে নামিয়ে দেবো?