- বইয়ের নামঃ সবাই গেছে বনে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আকাশের দিকে তাকালে
আকাশের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়।
অবিকল দেশের মতো মেঘ করেছে। চারদিক অন্ধকার করে একটু পরেই যেন কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হবে। আনিস কফি খেতে যাচ্ছিল। আকাশ দেখে তার খানিকটা মন খারাপ হয়ে গেল। বড্ড নষ্টালজিক মেঘ।
এ্যাণ্ডারসন ব্যস্ত ভঙ্গিতে পার্কিং লটের দিকে এগোচ্ছিল। আনিসকে দেখে থমকে দাঁড়াল, সরু গলায় বলল, এখনো বাড়ি যাও নি? প্রচণ্ড থাণ্ডারস্টর্ম হবে। ওয়েদার সার্ভিস স্পেশাল বুলেটিন দিচ্ছে।
কফি খেয়েই রওনা হব।
লিফট চাও? লিফট দিতে পারি।
না, লিফট চাই না।
এ অঞ্চলে ঝড় বৃষ্টি বড়ো একটা হয় না। সে জন্যেই সম্ভবত লোকজনদের ভয় একটু বেশি। দেখতে দেখতে ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে শুরু করেছে। কফি হাউসে মোটেই ভিড় নেই। উইক-এণ্ডে এ-রকম থাকে না কখনো! মেয়েরা সেজোগুজে বসে থাকে। ছেলেরা আসে ডেটের কথা পাকাপাকি করতে।
আনিস কফির পেয়ালা নিয়ে বা দিকে এগিয়ে গেল। কফি হাউসের শেষ মাথায় চার-পাঁচটি ছোট-ছোট ঘর আছে। তিন নম্বর ঘরটি আনিসের খুব প্রিয়। দারুণ ভিড়ের সময়ও সেটি ফাঁকা থাকে। আজ পুরো কফি হাউস ফাঁকা, কিন্তু সেখানে এক জন বুড়ি বসে আছে।
আমি কি এখানে বসতে পারি?
বুড়ি সম্ভবত ঘুমুচ্ছিল। আনিসের কথায় নড়েচড়ে বসল।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
বসার পরই আনিসের মনে হল কাজটি ভাল হয় নি। আমেরিকান বুড়িগুলো কথা না বলে থাকতে পারে না। ভ্যাজর ভ্যাজার করে দশ মিনিটের মধ্যে মাথা ধরিয়ে দেয়।
তুমি ইণ্ডিয়ান নিশ্চয়ই।
না, আমি ইণ্ডিয়ান নই।
তুমি কি মালয়েশীয়ান?
না, আমি বাংলাদেশী।
সেটি কোথায়?
ইণ্ডিয়া ও বার্মার মাঝামাঝি একটা ছোট দেশ।
কত ছোট?
বেশ ছোট। নর্থ ডাকোটার অর্ধেক হবে।
বুড়ি খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল আনিসকে। দাম ফুরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করবে।
তুমি কি শুনেছি, সিভিয়ার থাণ্ডারস্টর্ম হবে। স্পেশাল বুলেটিন দিচ্ছে দুপুর থেকে।
হাঁ শুনেছি। খুবই খারাপ ওয়েদার।
তুমি কি এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র?
না, আমি এখানকার এক জন টীচার।
কোন সাবজেক্ট?
কেমিস্ট্রি। পলিমার কেমিস্ট্রি।
আনিস বড়োই বিরক্তি বোধ করতে লাগল। বুড়িগুলির কৌতূহল সীমাহীন। এরা মানুষদের বড্ড বিরক্ত করতে পারে। বুড়িটি তার ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করল। লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, তুমি কি এমিলি জোহানের নাম শুনেছ?
না। কে সে?
এখানকার এক জন বড়ো কবি। গত বৎসর রাইটার্স গিল্ড এওয়ার্ড পেয়েছে।
না, আমি তার নাম শুনি নি। লিটারেচারে আমার তেমন উৎসাহ নেই।
বুড়ি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে তার হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি এমিলি জোহান। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।
আনিস হকচকিয়ে গেল। বুড়ি থেমে থেমে বলল, সমস্ত কফি হাউস ফাঁকা, আর তুমি বেছে বেছে আমার এখানে বসতে এসেছ দেখে ভাবলাম হয়তো আমাকে চেন, গল্প করতে চাও। বুড়িদের সঙ্গে ইচ্ছে করে কে আর বসতে চায় বল?
আনিস ঠিক কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু একটা বলা উচিত।
তুমি কিন্তু তোমার নাম বল নি এখনো।
আমার নাম আনিস সাবেত। তোমার মতো বড়ো কবির সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল।
বুড়ি গলার স্বর নামিয়ে ফেলল। প্রায় ফিসফিস করে বলল, মোটেই বড়ো কবি নই। রাইটার্স গিল্ড এওয়ার্ড হচ্ছে একটা সস্তা ধরনের পুরস্কার। এখন পর্যন্ত কোনো বড়ো কবি রাইটার্স গিল্ড এওয়ার্ড পায় নি। আমি যখন পেলাম তখন এত মন খারাপ হল যে বলার নয়। বুঝতে পারলাম যে আমি এক জন সস্তা ধরনের কবি, থার্ড রেট।
বুড়ি উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে কি আমার আবার দেখা হবে?
আনিসের উত্তর দেবার আগেই সে থেমে থেমে বলল,
ওয়ান ফ্লিউ টু দা ইস্ট
ওয়ান ফ্লিউ টু দা ওয়েস্ট।
এ্যাণ্ড ওয়ান ফ্লিউ ওভার দা কাক্কুস নেস্ট!
আনিস অনেকক্ষণ বসে রইল একা একা! এখান থেকে বাইরের আকাশ দেখা যাচ্ছে না, তবে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তা চোখে পড়ে। কত তফাৎ! ঝমোঝম শব্দ নেই, গাছের পাতার শনশনানি নেই, ব্যাঙ ডাকছে না। বোঝার কোনোই উপায় নেই যে বাইরে আকাশ অন্ধকার করে ঝড়ো হাওয়া বইছে।
এ্যাটেনশন প্লীজ এ্যাটেনশন প্লীজ। কফি হাউস দশ মিনিটের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। এ্যাটেনশন প্লীজ।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে মনে হল বড্ড বোকামি হয়েছে। অনেক আগেই বাড়ি ফেরা উচিত ছিল। ভালো ঝড় হচ্ছে। লোকজন কোথায়ও নেই। পার্কিং লাট ধু ধু করছে। আনিস মেমোরিয়াল লাউঞ্জে চলে গেল। মেমোরিয়াল লাউঞ্জে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা আছে। একটি প্রকাণ্ড ভিক্টোরিয়ান পিয়ানো আছে। হট চকলেট এবং পেপসির দুটি ভেণ্ডিং মেশিন আছে। অবস্থা তেমন খারাপ হলে সেখানকার সোফায় আরাম করে রাত কাটান যাবে।
লাউঞ্জের শেষ প্রান্তে একটি ছেলে এবং খুবই অল্পবয়সী একটি মেয়ে জড়াজড়ি করে বসে ছিল। ছেলেটি এক হাত দিয়ে মেয়েটির জামার হুঁক খোলবার চেষ্টা করছে। মেয়েটি বাধা দেবার একটি ভঙ্গি করছে এবং খিলখিল করে হাসছে। আনিস না দেখার ভান করে ভেণ্ডিং মেশিনের দিকে এগোল। এই সময় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। এখানে এরকম হয় না কখনো। হাজারো দুর্যোগেও এদের ইলেকট্রিসিটি ঠিকই থাকে। মনে হচ্ছে মেয়েটি উঠে আসছে সোফা থেকে।
তোমার কাছে কি সিগারেট আছে?