শাহানা নৌকার ছইয়ের ভিতর থেকে মাথা বের করে বলল–শুনুন, নীতু খুব ভয় পাচ্ছে। হারিকেনটা জ্বালাতে হবে।
মতি বলল, আপনি পারবেন না, আমি জ্বালায়ে দিব। ভয়ের কিছু নাই। ঢেউ থাকব না।
ও ঢেউকে ভয় পাচ্ছে না। আপনাকে ভয় পাচ্ছে। ওর ধারণা, আপনি খারাপ লোক। আপনার মতলব ভাল না।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর হাসির শব্দ শোনা গেল। এমন জোরালো হাসি শাহানা অনেকদিন শুনেনি। মতি হাসছে–মতির সঙ্গে মাঝিও যোগ দিয়েছে। তাদের হাসি আর থামছে না। হাসির মাঝখানে শাহানা নিচু স্বরে বলল–হাসির শব্দ শুনে তোর ভয় কেটেছে, না?
নীতু বলল, হ্যাঁ কেটেছে।
ভয়ংকর লোকজনও কিন্তু হাসতে পারে। একজন লোক শব্দ করে হাসলেই ধরে নিবি সে ভাল লোক তা কিন্তু না। তারপরেও হাসির শব্দ শুনলেই আমাদের ভয় কেটে যায়। কেন বল্ তো?
জানি না আপা।
আমি নিজেও জানি না।
মতি বলল, দেখি হরিকেনটা দেন। ধরাই।
নীতু বলল, হারিকেন ধরাতে হবে না। আপনি নৌকা চালান। আমার ভয়ে কেটে গেছে।
মতি বলল, ভয় কাটল কেন?
জানি না।
পেছনের মাঝি বলল, আমরার মতি ভাইজান এম মানুষ যারে পিঁপড়ায়ও ডরায় না।
নীতু বলল, আপনাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না–এটা কি সত্যি?
পিঁপড়া কোন মানুষরেই ডরায় না। ডরাইলে মানুষের মইধ্যে এত সহজে চলাফেরা করত না।
নীতু ফিসফিস করে শাহানাকে বলল–আপা, এই লোকটারও তোমার মত জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলার অভ্যাস।
তাই তো দেখছি।
তোমার কি ধারণা–উনি কি করেন?
আমার ধারণা কিছুই করে না। যারা কিছুই করে না জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলার দিকে তাদের প্রবল ঝোঁক থাকে। সব গ্রামে যেমন একটা করে পাগল থাকে তেমনি সব গ্রামে একটা করে অপদার্থ জ্ঞানী লোক থাকে। তারা অন্যদের মত লুঙ্গি-গেঞ্জি। পরে না। শার্ট-পেন্ট পরে খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা চুল রাখে, শুদ্ধ কথা বলার চেষ্টা করে এবং মাঝে মাঝে উদ্ভট কথা বলে মানুষদের চমকে দেবার চেষ্টা করে।
নীতু বলল, আমাদের এত সহজে চমকাতে পারবে না, তাই না আপা?
হ্যাঁ–আমাদের চমকানো খুব কঠিন বরং আমরা তাকে অতি সহজেই চমকে দিতে পারি।
ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা চালাতে বলে তুমি তো প্রথমেই চমকে দিয়েছ?
শাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–তোর খুব বুদ্ধি নীতু। তোর বুদ্ধি দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে চমকে যাই।
আপা!
হুঁ।
মাঝি যে বলল উনাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না–এটা কেন বলল?
গ্রামের মানুষ বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলতে পছন্দ করে এই জন্যে বলেছে। এইসব হচ্ছে কথার কথা। যেমন, সে আমাদের সম্পর্কে অন্যদের কাছে বলবে–আজ রাতে নৌকায় দুটা মেয়েকে পার করেছি। দুটাই পরীর মত সুন্দর। এর মধ্যে একটা মেয়ে এমন ভয় পাচ্ছিল, ভয়ে কিছুক্ষণ পর পর ফিট হচ্ছিল। কি, বলবে না এরকম?
নীতু হাসিমুখে বলল, মনে হচ্ছে বলবে। আপা শোন, তুমি আরও নিচু গলায় কথা বল–আমার মনে হয় ঐ লোকটা আমাদের সব কথা শুনছে।
না শুনছে না। ও নৌকা চালাতেই ব্যস্ত।
নীতু গলা বের করে মতির দিকে তাকিয়ে বলল–আচ্ছা, আপনি কি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন?
মতি বলল, জি পাইতেছি। নৌকার ছইয়ের ভেতকে ফিসফিস কইরা কথা বললেও বাইরে থাইক্যা পরিষ্কার শোনা যায়। ছইয়ের পেছনে পর্দা না থাকলে শোনা যাইত না–বাতাসে শব্দ ভাইস্যা যাইত। পিছনে পর্দা এই জন্যে সব শুনতাছি।
আমাদের কথায় রাগ করেননি তো?
জি না।
শীতে মতির শরীর কাঁপছে। ভেজা পাঞ্জাবিটা গা থেকে খুলে ফেলতে পারলে শীত কম লাগত। মেয়ে দুটাও তাকিয়ে আছে, পাঞ্জাবি খোলা ঠিক হবে না।
ইরতাজুদ্দিন সাহেবের নাতনী, এদের সামনে আদবকায়দার বরখেলাফ করা যায় না। মতির ধারণা, ইতিমধ্যেই সে আদবকায়দা অনেক বরখেলাফ করে ফেলেছে। মাস্টার সাহেব তাকে কথা কম বলতে বলেছেন, সে কথা কম বলেনি। বেশিই বলেছে। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। কারণ ছাড়াই কথা বলতে ইচ্ছা করে। মেয়ে দুটা সেই রকম। তবে বেশি সুন্দর। বেশি সুন্দর মানুষকে আপন বলে মনে হয় না, পর পর লাগে।
শাহানা বলল, আপনি কি করেন?
মতি লজ্জিত গলায় বলল, কিছু করি না। আফনের আন্দাজ ঠিক আছে।
মাঝি পেছন থেকে বলল, মতি ভাই হইল আফনের গানের দলের অধিকারী।
শাহানা বলল, সেটা কি?
মতি আগের চেয়েও লজ্জিত গলায় বলল–আমার একটা গানের দল আছে। ছোট দল।
বলেন কি? আপনি তাহলে মিউজিক্যাল টুপের কনডাক্টার? ইন্টারেস্টিং তে।
মতি অস্বস্তি ঢাকার জন্যে কয়েকবার কাশল। গানের দল করা এমন কোন কাজ না যে বড় গলায় বলতে হয়। এইসব পরিচয় গোপন রাখাই ভাল। গ্রামাঞ্চলে কাজকর্মহীন বাদাইম্যারা গানের দল করে, যাত্রার দল করে।
নীতু শাহানার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। নৌকার দুলুনীতে শাহানারও ঘুম আসছে।
গানের দল ছাড়া আপনি আর কিছুই করেন না?
মতি জবাব দিল না। অস্বস্তি ঢাকার জন্যে অকারণে কাশতে লাগল।
শাহানা বলল, গানের দল যারা করবে অন্য কিছু করার তাদের সময়ই বা কোথায়? এইসব হল ক্রিয়েটিভ কাজ, সৃষ্টিশীল কাজ। সৃষ্টিশীল কাজ যারা করে তারা অন্য কিছু করতে পারে না। তাদের মাথায় সব সময় একটা কাজই ঘুরে তো, সেই জন্যেই পারে না।
মতি মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর কথা! এ রকম সুন্দর কথা এই জীবনে কেউ তাকে বলেনি।
আপনার দল নিয়ে একদিন একটা উৎসব করবেন। আমরা শুনব।
জ্বি আচ্ছা।
আপনাদের কজনের দল?
চাইর জনের।
বাহ, সুন্দর তো–বিটলসদের দলেও ছিল চারজন।