কুম্ভীর বলছেন কেন? বলুন কুমীর। কুমীর বলা তো কুম্ভীর বলার চেয়ে অনেক সহজ। যুক্তাক্ষর নেই।
ঘটনাট! কি হইছে শুনেন আফা। সে এক ইতিহাস। আলিশান এক কুম্ভীর। এক গজ দুই ফুট লম্বা। দর্জির দোকানের গজ ফিতা আইন্যা মাপা হইল।
দয়া করে মিথ্যা গল্প বলে আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবেন না। এক গজ দুফিট লম্বা কুমীর এখানকার নদীতে কখনো পাওয়া যাবে না।
ঘটনা কিন্তুক সত্য আফা।
না ঘটনা সত্য না, ঘটনা মিথ্যা।
নীতুর রাগ দেখে মাঝি হেসে ফেলল। কাউকে রাগতে দেখে আনন্দিত হুর। সুযোগ তো সচরাচর পাওয়া যায় না। মাঝি শব্দ করে হাসছে। মাঝির সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে হাসছে মতি। হাসছে মুখ ঘুরিয়ে। হাসি দেখিয়ে মেয়েটিকে সে আরো রাগাতে চায় না। মতি বলল, বিরাট হৈ-চৈ হইছিল। ইত্তেফাক পত্রিকায় কুমীরের ছবি ছাপা হয়েছিল। এখনো লোকে ভয়ে নদীতে গোসল করে না।
নীতু থমথমে মুখে বলল, এটা সত্যি হতে পারে না। পত্রিকায় অনেক মিথ্যা খবর ছাপা হয়।
এই খবরটা সত্যি ছিল।
আপনি কি দেখেছিলেন কুমীরটা?
হ্যাঁ। নিজের চোখে দেখা। মানুষের মধ্যে যেমন অনেক পাগল মানুষ থাকে–যা করার কথা না, অন্যে যা করে না, তাই করে। পশু-পাখি, জীব-জানোয়ারের ভিতরেও সে রকম থাকে। ঐ কুমীরটার ছিল মাথা খারাপ। তার থাকার কথা ছিল সমুদ্রের কাছে। তা না কইরা উজানের দেশ দেখতে আইস্যা মারা পরল।
শাহানা কৌতূহলী হয়ে কথা শুনছে। মাথা-খারাপ কুমীরের কথা মাঝি শ্রেণীর কোন যুবকের মুখ থেকে সচরাচর শোনার কথা না। কিংবা কে জানে এই শ্রেণীর যুবকেরা হয়ত এভাবে কথা বলেই অভ্যস্ত।
নীতু বলল, তারপর কুমীরটাকে গ্রামের মানুষ কি করল?
দড়ি দিয়ে তিনদিন বাধা ছিল। তারপর পিটাইয়া মারল।
কেন?
কুমীরের কপালে ছিল মরণ লেখা।
তারপর কি হল?
কুমীরের দাঁতগুলি বিক্রি হইল। একেকটা দাঁত তিন টাকা। কুমীরের দাঁত দিয়া। ভাল তাবিজ হয়। আমরার এলাকায় কিছু গারো মানুষ আছে। তারা কুমীরটা পঞ্চাশ টাকায় কিনল।
কেন?
রাইন্দা খাইছে। পেট ভর্তি ছিল ডিম। ডিমগুলো আলাদা রান্না করছে আর শরীরটা আলাদা। ডিমগুলো খুব স্বাদ হইছিল।
বুঝলেন কি করে যে স্বাদ হয়েছিল?
আপনি খেয়ে দেখেছেন? হ্যাঁ একটা খাইছি। মুরগির ডিমের মতই। বেবাক কুসুম–শাদা অংশ কম।
আপনি সত্যি কুমীরের ডিম খেয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনার কথা আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম–এখন বুঝতে পারছি–আপনার সব কথা মিথ্যা। কুমীরের ডিম খাওয়ার কথা বলে আপনি ধরা পড়ে গেছেন।
মতি হাসছে–শব্দ করে হাসছে। মাঝিও হাসছে। নীতু রাগ করে নৌকায় ছইয়ের ভেতর চলে গেল। ফিসফিস করে বলল, আপা, লোকটা কি বলছিল তুমি কি শুনছিলে?
হুঁ।
তোমার কি ধারণা লোকটা কুমীরের ডিম খেয়েছে?
খেতে পারে। কিছু কিছু মানুষের স্বভাব হচ্ছে যে সে অন্যের চেয়ে আলাদা এটা প্রমাণ করার জন্যে উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করা। লোক দেখানো ব্যাপার আর কি। লোকজন হা করে তাকিয়ে থাকবে, দেখবে, বিস্মিত হবে–এতেই আনন্দ।
এরকম লোক সংখ্যায় খুব কম, তা না?
না, সংখ্যায় অনেক বেশি।
নীতু ফিসফিস করে বলল, আপা, কথাবার্তা আরো আস্তে বল–ঐ লোক শুনছে। মতি নামের কুমীরের ডিম খাওয়া লোকটা।
শুনুক না–গোপন কিছু তো বলছি না।
তবু আমাদের কথা অন্য মানুষ কেন শুনবে? মিথ্যাবাদী একজন মানুষ? আমার উনাকে অসহ্য লাগছে। শুধু শুধু কেন মিথ্যা বলবে?
শুধু শুধু মানুষ কখনো মিথ্যা বলে না। মিথ্যা যদি বলে থাকে তাহলে উদ্দেশ্য আছে–তবে আমার মনে হয় সত্যি কথাই বলছে–।
তোমার এরকম মনে হবার কারণ কি?
গ্রামের মানুষ তো! এরা মিথ্যা কম বলে–।
শহরের লোক মিথ্যা বেশি বলে?
হুঁ।
কেন?
শহরের লোকদের মিথ্যা বলার প্রয়োজন যতটা গ্রামের লোকদের ততটা না, এই জন্যে কম বলে।
নৌকা হঠাৎ দুলতে শুরু করেছে–এপাশ-ওপাশ করছে। নীতু চট করে ওঠে বসে আতংকিত গলায় বলল, কি হচ্ছে আপা? শাহানা জবাব দেবার আগেই মতি বলল, নৌকা বিলের মুখে পড়ছে এই জন্যে ঢেউ বেশি, ভয়ের কিছু নাই। ঢেউ থাকব না। এইগুলা হইল দেখন ঢেউ। কামের ঢেউ না।
নীতু ফিসফিস করে বলল–তোমাকে বলেছিলাম না আপা, আমাদের সব কথা শুনছে। কেউ আড়াল থেকে কথা শুনলে আমার ভাল লাগে না।
তাহলে কথা বলিস না, চুপচাপ শুয়ে থাক।
নীতু বাধ্য মেয়ের মত আবার শুয়ে পড়ল। মতি বলল, ভিতরের হারিকেনটা, নিভাইয়া দেন।
শাহানা বলল, কেন?
আন্ধাইর খুব জবর। ভিতরে হারিকেন জ্বললে বাইরের কিছু দেখা যায় না। দিক ভূল হয়। হারিকেন নিভাইয়া টর্চ লাইটটা আমার হাতে দেন।
শাহানা হারিকেন নিভিয়ে দিতেই চারদিকের অন্ধকার যেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেছনের মাঝি বলল, আরে সব্বনাশ! কি আন্ধইর রে! জন্মের আন্ধাইর।
নীতু শাহানার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল–আপা, লোকটার অন্য কোন মতলব নেই তো? হারিকেনটা নিভিয়ে দিতে বলল কেন?
লোকটাকেই জিজ্ঞেস কর, আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
তুমি তো পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর জান। এই জন্যে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
তোর এই প্রশ্নের উত্তর শুধু এই লোকটাই জানে।
স্টেশন থেকেই আমার মনে হচ্ছে লোকটা খারাপ–। আমার ভয় লাগছে আপা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখ। আমার শরীর কাঁপছে। আপা, পানি খাব।
নীতু আসলেই থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ অন্ধকার হওয়াতেই মনে হয় এই কাণ্ডটা ঘটেছে। নীতুর হার্টের কোন অসুখ-টসুখ নেই তো?