স্টেশন মাস্টার সাহেব অবাক হয়ে নীতুর দিকে তাকিয়ে রইলো কি অদ্ভুত কথা যে মেয়েটা বলে! শাহানা মুখ টিপে হাসছে…
ইঞ্জিন বসানো দেশী নৌকা। মাথার উপর ছই আছে। নিচে তোষক-চাদর-বালিশ দিয়ে সুন্দর বিছানা করা। চাদর বালিশ সবই পরিষ্কার। ছই থেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা এক হারিকেন। বালিশের কাছে একটা লম্বা টর্চ লাইট। নৌকা শাহানার খুব পছন্দ হল। শুধু ইঞ্জিনের ব্যাপারটা পছন্দ হল না–সারাক্ষণ ভট ভট শব্দ হবে–কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা ধরে যাবে। এখনো মাথা ভারি ভারি লাগছে। মতি নামের যে বিশ্বাসী লোকের কথা বলা হয়েছিল, দেখা গেল, সে নীতুর অপরিচিত নয়। স্টেশন পরের জানালায় তার মুখই দেখা গিয়েছিল–তখন তার মুখ যতটা ভয়ংকর লেগেছিল–এখন ততটা ভয়ংকর লাগছে না। নীতুর কাছে এখন লোকটাকে একটু যেন হবার মত লাগছে। লোকটার পরনে লুঙ্গি না–পায়জামা পাঞ্জাবি। পায়জামা আবার হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। খালি পা। খালি পায়ে কেউ পায়জামা পাঞ্জাবি পরে ঘুরে?
নীতু বলল, আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল না?
মতি লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি।
মতি ইঞ্জিন চালুর ব্যাপারে সাহায্য করছে। ঠাণ্ডায় ইঞ্জিন বসে গেছে মনে হয়। স্টার্ট নিচ্ছে না।
শাহানা বলল, ইঞ্জিনের নৌকা জোগাড় করেছেন?
জ্বি। দেড় ঘণ্টার মধ্যে ইনশাল্লাহ পৌঁছে যাব।
ইঞ্জিন না চালিয়ে যাওয়া যায় না?
অবশ্যই যাবে। এক সময় তো আমরা ইঞ্জিন ছাড়াই চলাফেরা করতাম। এখন না ইঞ্জিন হইল। ভটভটি ইঞ্জিন।
ইঞ্জিন ছাড়া কতক্ষণ লাগবে?
ভাল মাঝি হইলে চার-পাঁচ ঘণ্টা।
আমাদের মাঝি কেমন? মাঝি যদি ভাল হয় তাহলে ইঞ্জিন ছাড়া চালাতে বলুন–দরকার হলে কোনখান থেকে আরেকজন মাঝি জোগাড় করে আনুন। অনেকদিন। নৌকায় চড়া হয়নি। চড়ার সুযোগ যখন পাওয়া গেছে–ভালমত চড়া যাক। চারপাঁচ ঘণ্টা এমন কিছু বেশি সময় না।
নীতু বলল, চার-পাঁচ ঘণ্টা অনেক সময় আপা।
অনন্ত মহাকালের কাছে চার-পাঁচ ঘণ্টা কিছুই না নীতু।
আমার তো ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম পেলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে ঘুম ভেঙে দেখবি দাদাজানের বাড়ির ঘাটে নৌকা থেমে আছে।
চার-পাঁচ ঘণ্টা নৌকায় থাকলে নিশ্চয় আমাদের ডাকাতে ধরবে। আমার মন বলছে, এই অঞ্চলে খুব ডাকাতি হয়। আচ্ছা শুনুন, এই জ্বলে ডাকাতি হয় না?
প্রশ্নটা করা হল মতিকে, জবাব দিল মাঝি। সে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল–ডাকাতি বলতে গেলে রোজ রাইতে হয়—গত পরশু মোকামঘাটায় গয়নার নৌকায় বিরাট ডাকাতি। ডাকাইতে রামদা দিয়া হাতে কোপ দিছে।
নীতু ভীত গলায় বলল, মোকামঘাটা ঐখান থেকে কতদূর?
তা ধরেন আফনের সোয়া মাইল।
আমরা কি মোকামঘাটা হয়ে যাব?
হুঁ।
নীতু বলল–আপা শুনছ উনি কি বলছেন? মোকামঘাটায় ডাকাতরা রামদা দিয়ে কোপ মারে।
শাহানা বলল, আমাদের নৌকার ইঞ্জিন থাকবে বন্ধ। কোন রকম সাড়াশব্দ হবে। আমরা চুপি চুপি পার হয়ে চলে যাব। ডাকাতরা বুঝতেও পারবে না।
তোমার মাথা যে খারাপ এটা কি তুমি জান আপা?
জানি।
না, তুমি জান না। তোমার মাথা ভয়ংকর খারাপ। এই ব্যাপারটা শুধু যারা তোমার কাছাকাছি থাকে তারা জানে। আর কেউ জানে না। তোমার যে শুধু নিজেরই মাথা খারাপ তাই না–তোমার আশেপাশে যারা থাকে, তাদের মাথাও তুমি খারাপ করে দাও। নৌকায় যখন ডাকাত পড়বে তখন তুমি কি করবে?
এমন অদ্ভুত কিছু করব যেন ডাকাতরা পুরোপুরি হকচকিয়ে যায়। যেমন ধর, ডাকাতদের যে হেড তাকে বলব–ভাই, আপনি কি গান গাইতে পারেন?
তোমার এই সস্তা রসিকতায় আমি কিন্তু মোটেই মজা পাচ্ছি না, আপা।
তুই মজা না পেলেও অন্যরা কিন্তু পাচ্ছে।
অন্যরা যে মজা পাচ্ছে–তা সত্যি। নীতু নৌকার মাঝিকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার বিশ্রী ভ্যাক ভ্যাক হাসি শোনা যাচ্ছে। মতি নামের লোকটা এ রকম বিশ্রী। করে না হাসলেও–হাসছে! দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। নীতুর গা জ্বালা করতে লাগল।
শাহানা বলল, নীতু, তুই আমার কথা শোন–টেনশানে তুই অসুখ বাঁপিয়ে ফেলবি। ধাই করে ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে, রক্তে সুগার যাবে কমে… দুই নিশ্চিন্ত হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাক…যা হবার হবেই…আগেভাগে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বর্তমান নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তুই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাক তো। কি সুন্দর ঝমঝমে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির ভেতর নৌকা নিয়ে যাওয়া কত ইন্টারেস্টিং এডভেঞ্চার! আয় নীতু।
নীতু এগিয়ে এল এবং আপার কোলে মাথা রেখে ওর পড়ল। সে মতির দিকে তাকিয়ে বলল, মোকামঘাটা পার হলে দয়া করে আমাকে ডেকে তুলবেন।
জি আচ্ছা।
নৌকা চলতে শুরু করছে। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে–হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটা ফোঁটা শুধু পড়ছে। মতি হাতে লগি নিয়েছে। পেছনের মাঝি দাঁড় টানছে, মতি লগি ঠেলছে। লগি ঠেলে অভ্যাস নেই। কষ্ট হচ্ছে। উপায় কি! নীতু ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সে পানিতে হাত দিচ্ছে। কি ঠাণ্ডা পানি! পানিতে হাত দিতে তার খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে। পানি থেকে সাপখোপ যদি তার গা বেয়ে উঠে আসে।
ভীতু মানুষকে ভয় দেখাতে খুব ভাল লাগে। নৌকার মাঝি দ্বিতীয় ভয়ের গল্প ফাঁদল।
ছোট আফা, পানির মইধ্যে কিন্তুক হাত দিবেন না। পানির মইধ্যে কুম্ভীর আছে।
নীতু বিরক্ত গলায় বলল, ময়মনসিংহের নদীর পানিতে কুমীর থাকবে কেন? কুমীর থাকবে সমুদ্রের কাছাকাছি নদীতে।
এইটাই তো আচানক কথা। গত বছর বাইস্যা মাসে কারেন্ট জালে এক কুম্ভীর ধরা পড়ল।