মতি সুযোগ পেয়েই ঋষির মত এক বাণী দিয়ে ফেলল। পিঁপড়াদের জীবনচর্যা বিষয়ক এই বাণী সে প্রায়ই দেয়। জগলুর উপর এই বাণী তেমনি প্রভাব ফেলল না।
সে হাই তুলল।
মনসুর আলি সাহেব হন হন করে আসছেন। তিনি পয়েন্টসম্যান বদরুলকে খুঁজে পেয়েছেন। বদরুল তাঁর মাথার উপর ছাতা ধরে আছে। মনসুর আলির হাতে। ছোট একটা এলুমিনিয়ামের কেতলি। অন্য হাতে দুটা চায়ের কাপ। মনসুর আলির চোখে সমস্যা আছে–কাছাকাছি কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও চিনতে পারেন না। আজ মতিকে দূর থেকে চিনে ফেললেন–খুশি খুশি গলায় বললেন, কে, মতি না?
মতি হাসিমুখে বলল, স্যারের শরীর কেমন?
শরীর ভাল। তুই এখানে করছিস কি?
চা খাই।
চা পরে খাবি–তুই আমার একটা কাজ করে দে। বিরাট ঝামেলায় পড়েছি। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের দুই নাতনী এসে উপস্থিত। স্টেশন ঘরে বসে আছে। ওদের। সুখানপুকুর নিয়ে যাবি। পারবি না?
অবশ্যই পারব।
নৌকা জোগাড় কর। ভাল ইঞ্জিনের নৌকা। নিচে বিছানা দিতে হবে। পারবি না?
মানুষ পারে না এমন কাজ দুনিয়াতে আল্লাহপাক দেয় নাই। হযরত আদমকে পয়দা করার পর আল্লাহপাক বললেন–ওহে আদম…
বড় বড় কথা বলার কোন দরকার নাই–তুই যা, নৌকা জোগাড় কর। আর শোন–তোর বেশি কথা বলার অভ্যাস। বেশি কথা বলবি না।
জ্বে আচ্ছা।
জ্বে আচ্ছা না–কোন কথাই বলবি না।
জে আচ্ছা, বলব না–তবে ইরতাজ সাহেবের যখন নাতনী তখন তো। আমরার গ্রামেরই মেয়ে…।
খবর্দার। গ্রামের মেয়ে আবার কি?
মনসুর আলিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন পুরোপুরি দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছেন। ঘাম দিয়ে জ্বর সেরে রোগি বিছানায় উঠে বসেছে। মনসুর আলি জগলুর দিকে তাকিয়ে বললেন–মতির চায়ের পয়সা আমি দেব। ওর কত হয়েছে?
দুই কাপ চা খাইছে। দুই টাকা।
মনসুর আলি আনন্দিত গলায় বললেন–তুই তাহলে নৌকার খোঁজে চলে যা। নৌকা পেলে আমাদের খবর দিবি।
জ্বে আচ্ছা।
মতি মাথা চুলকে বলল, আফনের টাকাটার একটা ব্যবস্থা স্যার করতেছি। সতেরো টাকা পাওনা ছিল, স্যারের বোধ হয় ইয়াদ আছে।
আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
মনসুর আলি কেতলিতে করে নিজের বাড়ি থেকে চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। গলুর দোকানে কেতলি গরম করলেন। এক পোয়া জিলাপি কিনলেন–মেয়ে দুটির নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে–এমন জংলী জায়গা… কিছু পাওয়ার উপায় নেই।
মতি!
জ্বি স্যার।
কথা কম বলবি–এরা শহরের বড়ঘরের মেয়ে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। কথা শুনলে বিরক্ত হয়–কি দরকার বিরক্ত করার।
বিরক্ত করব না।
নৌকায় উঠেই ফট করে গানে টান দিবি না। এরা শহর-বন্দরে থাকে, গ্রাম্য গান শুনলে বিরক্ত হবে। কোন গান না।
জি আচ্ছা।
মনসুর আলি আবার তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মতিকে পেয়ে তার সত্যি ভাল লাগছে।
নীতু উৎসাহের সঙ্গে বলল, আপা, স্টেশন মাস্টার সাহেব আসছেন।
তুই তো বিড়াল হয়ে যাচ্ছিস রে নীতু। অন্ধকারে সব দেখতে পাস। আমি তো কিছু দেখি না। উনি কি খালি হাতে আসছেন, না চা নিয়ে আসছেন?
চা নিয়ে আসছেন, হাতে কেতলি আছে।
চা-টা গরম, না ঠাণ্ডা?
সেটা বুঝব কি করে?
চা গরম হলে কেতলির মুখ দিয়ে ধোয়া বেরুবে। ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছিস না হই তো মনে হয় আলোর চেয়ে অন্ধকারেই ভাল দেখিস…।
বৃষ্টি কমে এসেছিল, আবার প্রবলবেগে শুরু হল। হারিকেনে সম্ভবত তেল নেই–উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। তেল ভরা থাকলে এত সুন্দর করে জ্বলত না।
মনসুর আলি বললেন, আম্মারা, চা খান। চিন্তার আর কিছু নাই। সব ব্যবস্থা হয়েছে।
শাহানা বলল, কি ব্যবস্থা হয়েছে?
ব্যবস্থা তেমন কিছু হয়নি, শুধু মতিকে পাওয়া গেছে। মতি সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। মনসুর আলি এই ভরসাতেই বলেছেন সব ব্যবস্থা হয়েছে।
নীতু বলল, আমরা যাব কি ভাবে? হেঁটে?
জ্বি না আম্মা, নৌকায় যাবেন।
নৌকায় কতক্ষণ লাগবে?
নৌকায় কতক্ষণ লাগবে সেই সম্পর্কেও তাঁর কোন ধারণা নেই। নৌকায় করে তিনি কখনো সুখানপুকুর যাননি। নৌকায় যেমন যাননি–হেঁটেও যাননি। যাবার প্রয়োজন পড়েনি। তবে এবার যাবেন। মেয়ে দুটি থাকতে থাকতে যাবেন। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। এদের একটা-দুটা কথায় অনেক কিছু উলটপালট হয়। তিনি সাত বছর এই জঙ্গলে পড়ে আছেন। তার জুনিয়ররা প্রমোশন নিয়ে ভাল ভাল স্টেশন পেয়েছে। তার কিছু হয়নি। মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হয় রেলওয়ের খাতায় তার নাম আছে কি-না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবকে দিয়ে একটা কথা রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানের কানে তুলতে পারলে–
আম্মারা, জিলাপি খান। সন্ধ্যার সময় ভাজে। কারিগর ভাল–।
নীতু বলল–যে জিলাপি ভাজে তাকে কি কারিগর বলে?
ভাল ভাজলে কারিগর বলে।
নীতু জিলাপি এক টুকরা মুখে দিল। ন্যাতন্যাতে জিলাপি–টক টক লাগছে–একবার মুখে দিয়ে ফেলে দেয়াও যায় না–অভদ্রতা হয়। ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। শাহানা সহজভাবে বলল, মুখে জিলাপি দিয়ে বসে আছিস কেন? ভাল না লাগলে ফেলে দে। নীতু তৎক্ষণাৎ জানালার কাছে চলে গেল। জিলাপি ফেলে দিলে এখন আর অভদ্রতা হবে না। সে নিজ থেকে ফেলেনি–অন্যের কথায় ফেলেছে।
শাহানা বলল, আমরা কখন রওনা হব?
নৌকা ঠিক হলে খবর দিবে। তখন আল্লার নাম নিয়ে রওনা দিব।
আপনি কি যাবেন আমাদের সঙ্গে?
জি না আম্মা। মতি যাচ্ছে, অসুবিধা হবে না। খুব বিশ্বাসী ছেলে।
নীতু বলল, অবিশ্বাসী ছেলে হলে কি করত? আমাদের খুন করে স্যুটকেস-টুটকেস নিয়ে চলে যেত?