মিতুর ধারণা ঠিক না, আমি যাব।
কবে যাবে?
তুমি যখন যেতে বলবে। তুমি কবে যেতে চাও?
আমি তো এক্ষুণি যেতে চাই। প্রচণ্ড সব ঝামেলা ফেলে এসেছি। যাই হোক, কাল দুপুরের দিকে রওনা হলে রাতে ঢাকা পৌঁছতে পারি। তোমার অসুবিধা আছে?
না, অসুবিধা নেই।
এই সময়ের মধ্যে হার হাইনেসের রাজত্ব যতটা পারি দেখে নের। দেখার কিছু কি আছে এখানে?
ছোট একটা দীঘি আছে। চারদিক কদমগাছে ঘেরা। শুধু যে অপূর্ব তাই না, মনে হয় জায়গাটা বেহেশতের একটা অংশ ছিল, ভুলে পৃথিবীতে চলে এসেছে। দীঘিটার নাম হল অশ্রুদীঘি।
বল কি! গ্রামের এক দীঘির এ রকম কাব্যিক নাম? কে রেখেছে এই নাম?
আমি।
তুমি?
হুঁ। আমি।
এত সুন্দর দীঘি যদি হয় তার নাম অশ্রুদীঘি হবে কেন?
দীঘিটা দেখলে আনন্দে চোখে পানি এসে যায়, এই জন্যেই তার নাম রেখেছি, অশ্রুদীঘি।
মোহসিন দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার মধ্যে যেমন প্রবল কাব্য ভাব আছে তা জানতাম না।
শাহানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি নিজেও জানুতাগী এখানে এসে অনেক কিছু জেনেছি।
যেমন?
যেমন, আগে ভাবতাম আমার স্বপ্ন হচ্ছে পৃথিবীর বড় ডাক্তারদের মধ্যে একজন হওয়া। এখানে এসে মনে হল এটা ভুল স্বপ্ন। আমার আসল স্বপ্ন অন্য।
আসল স্বপ্ন কি?
আসল স্বপ্ন গ্রাম্য একটা গানের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পথে পথে গান গাওয়া–কে পরাইল আমার চউক্ষে কলংক কাজল।
মিতু ঠিকই বলেছে–দ্রুত তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া উচিত।
শাহানা অস্পষ্ট গলায় বলল, সব মানুষের মধ্যে নানান ধরনের স্বপ্ন থাকে। তার মধ্যে কোটা সত্যি স্বপ্ন কোটা মিথ্যে স্বপ্ন সে ধরতে পারে না। মানুষ সব সময়ই বাস করে একটা বিভ্রমের ভেতর।
মোহসিন হাসতে হাসতে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তোমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হওয়া উচিত।
শাহানা হাসল। মোহসিন বলল, যাক, অনেকক্ষণ পর তোমার হাসি দেখলাম।
আগে একবার হেসেছি, তুমি লক্ষ্য করনি।
মোহসিন বলল, তোমার কথাবার্তা খুব হাই ফিলসফির দিকে টার্ন করছে। সহজ কথাবার্তা কিছু বলা যায় না?
যায়। চকোলেট রঙের এই শার্টে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে এবং তুমি যে এত সুপুরুষ তা ঢাকায় থাকতে বুঝতে পারিনি।
থ্যাংকস। এই তো, এখন কথাবার্তাগুলি শুনতে ভাল লাগছে। চল, তোমার অশ্রুদীঘি দেখে আসি।
এখন না। আরেকটু পরে চল। আজ পূর্ণিমা। চাঁদ উঠুক, তারপর যাব।
অশ্রুদীঘির চারপাশে আমরা যদি হাত ধরাধরি করে হাঁটি তাহলে গ্রামের লোক কিছু মনে করবে না তো?
না। আচ্ছা, তুমি কি গান শুনবে?
কে গাইবে? তুমি?
না। আমি গান জানি না কি? এখানে একজন গায়ক আছেন–মতি–উনাকে খবর দিলে…।
কাউকে খবর দিতে হবে না। আমরা হাত ধরাধরি করে অশ্রুদীঘির চারপাশে হাঁটব। গানের দরকার হবে না। আমাদের সবার ভেতর গান আছে বিশেষ বিশেষ সময়ে সেই গান আপনাআপনি কানে বাজতে থাকে… দেখলে তো, দার্শনিক কথাবার্তা আমিও বলতে পারি।
মোহসিন আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠে গেছে–এখনো আলো ছড়াতে শুরু করেনি। শাহানা অপেক্ষা করছে।
মোহসিন বলল, রাজকন্যা তুমি কি আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে?
হাঁটু গেড়ে বস তারপর হাসব।
মোহসিন সত্যি সত্যি হাঁটু গেড়ে বসতে গেল। শাহানা হাত ধরে থামাল।
আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ উঠেছে
আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ উঠেছে। জোছনার প্রাবনে থৈ থৈ করছে সুখানপুকুর। তরল জোছনা, মনে হয় ইচ্ছে করলেই এই জোছনা গায়ে মাখা যায়।
জোছনা গায়ে মেখে কুসুম জলচৌকিতে একা একা বসে আছে। সে সন্ধ্যা থেকেই কাঁদছে। তার ভেজা গালে জোছনা চক চক করছে। কুসুমের কান্না বাড়ির সবাই দেখছে কেউ গায়ে মাখছে না। বিয়ের কন্যাতো কাঁদবেই। কাঁদাটাইতো স্বাভাবিক।
কুসুমের বিয়ে ঠিক হয়েছে আজ বিকেলে। তার বড় খালা হুট করেই সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। মনোয়ারাকে ডেকে বললেন, গরীব ঘরের মেয়ের বিয়া। জামাই হাতীর পিঠে চইড়া আসব না। জামাই ঘরে বসা। জিনিশটা ভাল দেখায় না। মৌলবী ডাক দিয়া কবুল দিয়া দেও। এজিন কাবিন হইয়া থাকুক। পরে এক সময় গেরামের মানুষের খাওয়াটা দিবা।
মনোয়ারা বলেছেন–আফনে যেটা ভাল বিবেচনা করেন।
আমি এইটাই ভাল বিবেচনা করি।
ছেলেরে জিজ্ঞেস করা দরকার না বুবু তার একটা মতামত।
জিজ্ঞেস করতাছি।
কুসুমের খুব আশা ছিল ছেলে রাজী হবে না। শখ করে কে চাইবে জ্বীনে পাওয়া মেয়েকে বউ করতে। কুসুমকে অবাক করে দিয়ে সুরুজ আলি মিনমিন করে লল, আফনে আমার মার মত। আফনে যা নির্ধারন করবেন…
নিন্দালিশের খালা বললেন, আইজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার দিন বিবাহ সুখের হয় না। কাইল একজন মৌলবী খবর দিয়া আনি। দশ হাজার এক টাকা কাবিনে বিবাহ রাজি আছ?
সুরুজ আলি পায়ের নখ দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল, আফনে আমার মুরুব্বী।
তিনি একশ টাকার দুটা নোট বের করে দিয়ে বললেন, পায়জামা, পাঞ্জাবী আর টুপী কিনা আন। কালা টুপী কিনবা না।
কুসুমকে হতভম্ভ করে সুরুজ আলি টাকা নিয়ে পায়জামা, পাঞ্জাবী কিনতে চলে গেল। তারপরেও কুসুমের মনে ক্ষীণ আশা ছিল হয়ত টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবে। খালি হাতে পালিয়ে যাবার চেয়ে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ভাল।
সুরুজ আলি পালায় নি। সন্ধ্যার আগেই ফিরেছে। নাপিতের দোকানে চুল কাটিয়েছে।
মৌলবী ডাকিয়ে তিনবার কবুল বলিয়ে যে বিয়ে হবে তারও আয়োজন লাগে। কুসুমের বাড়ির সবাই সেই আয়োজনে ব্যস্ত। আশে পাশের বাড়ির মেয়েরাও এসে জুটেছে। চিকণ করে সুপারী কাটা হচ্ছে। পানের খিলি বানানো হচ্ছে। হাতের সেমাই বানানোর জন্যে চালের গুড়ি তৈরী হচ্ছে। পুষ্পের খুব শখ মাঝ রাত থেকে বিয়ের গীত হবে। সে গেছে বিয়ের গীতের মানুষ জোগাড় করতে। বিয়ের গীতের আসল মানুষ মরিয়মের মা। খবর পেলেই তিনি চলে আসবেন। সাপের ওঝার যেমন সাপে কাটা রুগীর খবর পেলেই আসতে হয়। বিয়ের গীত যারা গায় তাদেরও তেমনি বিয়ের খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসতে হয়।