তুই ঐ লোকটার দিকে তাকাবি না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাক।
নীতু অন্যদিকে তাকাল না। লোকটির দিকেই তাকিয়ে রইল। তার গা আসলেই ঘিন ঘিন করছে। নানান কারণেই করছে। পা ধোয়া হলেও তার ধারণা পা থেকে গোবরের গন্ধ পুরোপুরি যায়নি। বাড়িতে পৌঁছেই সাবান মেখে গোসল করতে হবে। পা আলাদা করে স্যাভলন দিয়ে ধুতে হবে। কে জানে দাদার বাড়িতে স্যাভলন আছে। কি-না। সঙ্গে করে স্যাভলনের একটা বড় বোতল নিয়ে আসা দরকার ছিল।
আপা!
হুঁ।
দাদাজানের বাড়িতে কি স্যাভলন আছে?
নীতু! তুই মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করিস। হঠাৎ করে স্যালনের কথা এল কেন? তাছাড়া দাদাজানের বাড়িতে স্যাভলন আছে কিনা আমি জানব কি ভাবে?
লোকটা আরেকটা বিড়ি খাচ্ছে আপা। এখন চলে যাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে নেমে গেল–ওর তো বিড়ি ভিজে নিভে যাবে।
নিভে গেলে আবার ধরাবে। পকেটে নিশ্চয়ই দেয়াশলাই আছে।
দেয়াশলাইও তো ভিজে যাবে।
প্লীজ নীতু, তুই আর একটা কথাও বলবি না। তোর কথা শুনে এখন আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।
আপা লোকটা কিন্তু ভয়ংকর। ওর চোখের মধ্যে খুনী খুনী ভাব।
চুপ নীতু, আর একটা কথা না।
নীতুর পর্যবেক্ষণশক্তি এবং অনুমানশক্তি দুই-ই বেশ ভাল। তবে মতির ক্ষেত্রে তার এই ক্ষমতা কাজ করেনি। মতি ভয়ংকরদের কেউ না, অতি সাধারণদের একজন। সুখানপুকুরে তার একটা গানের দল আছে। সে গানের দলের অধিকারী। লম্বা চুলের এই হল ইতিহাস। গানের দলের অধিকারীর কদমছাঁট চুলে মানায় না। মাথায় উকুন হলেও চুল লম্বা করতে হয়। নীতুর কাছে মতির চেহারা কুৎসিত এবং ভয়ংকর মনে হলেও–তার চেহারা ভাল। লম্বা চুলে তাকে ঋষি ঋষি মনে হয়। সে কথাবার্তাও ঋষির মত বলার চেষ্টা করে। মতি লম্বা রোগা একজন মানুষ। টকটকে ফর্সা রঙ তবে এখন রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে।
মতি স্টেশন মাস্টারের খোঁজ করছিল, কারণ মাস্টার সাহেব তার কাছে সতেরো টাকা পান। অনেকদিন থেকেই পান। মতি টাকাটা দিতে পারছে না। টাকা দিতে পারছে না বলেই পাওনাদারকে এড়িয়ে চলবে, মতি সেই মানুষ না। ঠাকরোকোনা স্টেশনের আশেপাশে কোথাও এলেই সে স্টেশন মাস্টারের খোঁজ করে যায়। সতেরো টাকার কথা তার মনে আছে, এই সংবাদ এক ফাঁকে দেয়। টাকাপয়সার কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট হয়। তার ক্ষেত্রে এটা সে হতে দিতে রাজি না।
স্টেশনঘরে মেয়ে দুটিকে দেখে মতির বিস্ময়ের সীমা রইল না। আকাশের পরীরাও এত সুন্দর হয় না। পরী সুন্দর হয় এটা অবশ্য কথার কথা। পরীরা মোটেই সুন্দর হয় না। মতি নিজে পরী দেখেনি, তবে মতির ওস্তাদ শেলবরস খা পরী দেখেছেন। শেষ বয়সে একটা পরীকে তিনি নিকাহ করেছিলেন। মাঝরাতে মাঝরাতে সেই পরী আসত। শেলবরস তাঁর সঙ্গে রং-ঢং করে শেষরাতে চলে যেত। শেলবরস খাঁ নিজের মুখে বলেছেন–পরী দেখতে সুন্দর না। এরার মুখ ছোট ছোট। ইঁদুরের দাতের মত ধারালো দাঁত। গায়ে মাছের গন্ধের মত গন্ধ! আর এরা বড় ত্যক্ত করে।
মতি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জগলুর চায়ের স্টলে গিয়ে বসল। জগলু বিরক্ত চোখে তাকাল। মতির মনটা খারাপ হয়ে গেল–কাস্টমার এসেছে, কোথায় খাতিরযত্ন করে বসাবে তা না, এমন ভাব করছে যেন…
মতি বলল, জগলু ভাই আছেন কেমন, ভাল?
জগলু হাই তুলল। জবাব দিল না।
দেখি চা দেন। বাদলা যেমন নামছে চা ছাড়া গতি নাই।
জগলু নিঃশব্দে গ্লাসে লিকার ঢালছে। তার মুখের বিরক্তি আরো বেড়েছে। বিরক্তির কারণ হচ্ছে–সে মোটামুটি নিশ্চিত মতির কাছে পয়সা নেই। দীর্ঘদিন চায়ের স্টল চালাবার পর তার এই বোধ হয়েছে—কার কাছে পয়সা আছে, কার কাছে নেই তা সে আগেভাগে বলতে পারে। বিনা পয়সার খরিদ্দার দোকানে ঢুকেই রাজ্যের গল্প শুরু করে। জগলুকে জগলু না ডেকে ডাকে জগলু ভাই। চা মুখে দিয়েই বলে ফাসক্লাস চা হইছে জগলু ভাই। মতিও তাই করবে।
মতি চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিশ্চয় ফলে বলল, চা জবর হইছে জগলু ভাই। তারপর কন দেখি, আপনেরার খবর কন।
খবর নাই।
মাস্টার সাবের খুঁজে গিয়া এক ঘটনার মধ্যে পড়লাম… দেখি পরীর মত দুই মেয়ে…
জগলু মতির কথা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, চা শেষ কর মতি–দোকান বন্ধ করব।
চা তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার জিনিশ না। আরাম করে খেতে হয়। জগলুর দোকানে চা-টা বানায় ভাল। আফিং-টাফিং দেয় কি না কে জানে। আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু মতির হাতে আসলেই পয়সা নেই। বাকিতে একবার চা খাওয়া যায়, পরপর দুবার খাওয়া যায় না।
চা আরেক কাপ খাওন লাগব জগলু ভাই–সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজছি–শরীর মইজ্যা গেছে।
চায়ের দাম কিন্তু বাড়ছে–এক টেকা কাপ। দুই কাপ দুই টেকা।
কন কি?
কুড়ি টেকা সের চিনি–পনেরো টেকা গুড়। আমার হাত বান্দা।
আচ্ছা দেন, উপায় কি?
জগলুর মুখের বিরক্তি ভাব এখন কিছুটা দূর হয়েছে। কথা শুনে মনে হচ্ছে–মতির হাতে পয়সা আছে। চায়ের দাম দেবে। তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করা যেতে পারে।
স্টেশন ঘরে কি দেখলা বললা না?
পরীর মত দুই মেয়ে। যেমন সুন্দর চেহারা তেমন সুন্দর কথা।
বিষয় কি?
জানি না। জিজ্ঞাস করলাম, কিছু বলে না। এরা হইল শহরের মেয়ে, আর আমার হইল আউলা বাউলা চেহারা। চেহারা দেইখ্যাই ভয় পাইছে। মেয়ে দুইটার, পরিচয় জাননের ইচ্ছা ছিল।
পরিচয় জাইন্যা হইব কি?
তবু পরিচয় জানার ইচ্ছা হয়। দুইটা পিঁপড়া যখন সামনাসামনি দেখা হয়–তারা থামে। সালাম দেয়, কোলাকুলি করে, একজন আরেকজনের খোঁজখবর নেয়, আর আমরা হলাম মানুষ…।