আপা,
তোমার চিঠি সব মিলিয়ে দশবার পড়লাম। আর কয়েকবার পড়লে মুখস্থ হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। কাজেই ঠিক করেছি আর পড়ব না। তোমার চিঠির জবাব পরে দিচ্ছি, আগে জরুরী খবরগুলি দিয়ে নেই।
জরুরী খবর নাম্বার ওয়ান–জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্টস এডভাইজার তোমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। তুমি ডরমিটরিতে থাকতে চাও না। নিজে বাসা ভাড়া করে থাকতে চাও তা তোমাকে অতি দ্রুত জানাতে বলেছেন।
জরুরী খবর নাম্বার টু–তোমার অতি শখের তিনটি ক্যাকটাসই মারা গেছে। আমি তাদের বাঁচিয়ে রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। বলধা গার্ডেনের একজন এক্সপার্ট পর্যন্ত খবর দিয়ে এনেছি, লাভ হয়নি।
জরুরী খবর নাম্বার থ্রি–আমাদের বাড়িতে দুতের উপদ্রপ হচ্ছে। আমার বাথরুমটার কল আপনাআপনি খুলে যায়। ছরছর করে পানি পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় পানি দিয়ে কে যেন হাত-মুখ ধুচ্ছে। তুমি তোমার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয়ই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে–আমি পারছি না। আমি ভয় পেয়ে বাড়ি ছেড়ে বর্তমানে ছোট মামার বাড়িতে আছি। ছোট মামীর কথাবলা রোগ আরে বেড়েছে। তিনি ক্রমাগত আমার কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে যাচ্ছেন। এখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভূতের বাড়িতে থাকাই ভাল ছিল। ভূতটা আর যাই করুক ক্রমাগত কথা বলে না। কল খুলে মাঝে মাঝে শুধু হাত-মুখ ধোয়।
যাই হোক আপা, এখন তোমার চিঠির জবাব দিচ্ছি। যদিও আমার জবাবের জন্য তুমি অপেক্ষা করছ বলে আমার মনে হয় না। তার প্রয়োজনও নেই। তোমার সমস্যা তুমি সবচে আগে টের পাবে এবং তোমার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সমস্যার সমাধান করবে এটা আমি জানি। তোমার সমস্যা তুমি আমাকে স্পষ্ট করে বলোনি।
অনুমান করছি, তুমি জনৈক গ্রাম্য গায়কের প্রতি তীব্র দুর্বলতা পোষণ করছ। দুর্বলতা গানের জন্য হলে সমস্যার কোন কারণ নেই–দুর্বলতা মানুষটির জন্যে হলে অবশ্যই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
আমার ধারণা গ্রামের পরিবেশ, প্রকাণ্ড হাওড়, শ্রাবণ মাসের আকাশের মেঘ এবং ঝর ঝর বৃষ্টি, দাদাজানের রূপকথার রাজা-বাদশার মত কাঠের বাড়ি–সব তোমার উপর একটা প্রভাব ফেলেছে। মনে উদ্ভট সব খেয়াল জাগছে। এসব খেয়ালকে প্রশ্রয় দেবার প্রশ্নই উঠে না। গ্রামের গায়ক গ্রামেই থাকুক–গান গাইতে থাকুক। তুমি চলে যাও তোমার নিজের জায়গায়।
মনের দেয়াল ভেঙে বৈপ্লবিক কিছু করে ফেলার চিন্তা মেয়েরা ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সে করে। ঐ বয়স তুমি পার হয়ে এসেছ।
ঐ গায়কের গান শুনতে চাও খুব ভাল কথা, ক্যাস্টে ভর্তি করে গান নিয়ে এসো। যখন শুনতে ইচ্ছা করবে, শুনবে। তার জন্যে গায়ককে নিয়ে আসতে হবে কেন?
আপা, আশা করি, আমার এই ধরনের রূঢ় কথা তোমাকে আহত করবে না। কথাগুলি রূঢ় হলেও সত্যি। সত্যকে গ্রহণ করার সাহস তোমার আছে।
মোহসিন ভাইকে বলতে গেলে আমি জোর করে পাঠিয়েছি। বেচারার এখানে অনেক কাজ ছিল। কাকতালীয়ভাবে উনি যেদিন সুখানপুকুর পৌঁছবেন সেদিন পূর্ণিমা। যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা খুব সুন্দর হবার কথা! তুমি অবশ্যই পূর্ণিমার রাতে মোহসিন ভাইকে নিয়ে ছাদে বসবে। অনেক রাত পর্যন্ত দুজন গল্প করবে।
চিঠি প্রায় শেষ। এখন শুধু জরুরী খবর নাম্বার ফোরটা বলি–তোমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে ২৭শে শ্রাবণ। কাজেই চলে এসো।
ইতি
মিতু
মোহসিন সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠল। নীতুই ঘুম থেকে তুলল–আর কত ঘুমুবেন? উঠুন, আপা আপনার সঙ্গে চা খাবে বলে চা না খেয়ে বসে আছে।
ম্যারাথন ঘুম দিয়ে দিয়েছি, তাই না নীতু?
হুঁ।
খিদেও লেগেছে মারাত্মক।
খিদে লাগলেও আপনাকে কিছু খেতে দেয়া হবে না। এখন খেলে রাতে আবার ভাত খাবেন না।
তুমি তোমার আপাকে বল–আমি আসছি। সেজেগুজে নিজেকে প্রেজেন্ট করি। তোমরা যে আসলে রাজকন্যা তা তো জানতাম না। এখানে এসে জানলাম। রাজকন্যার সামনে তো আর গেঞ্জি গায়ে উপস্থিত হওয়া যাবে না।
নীতু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আমরা যে রাজকন্যা সেটা আমরাও জানতাম না। এখানে এসে জেনেছি।
মোহসিন হাসতে হাসতে বলল, তুমি এখন আমাকে একটা বুদ্ধি দাও। তোমার আপার সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন কি কুর্নিশ করতে হবে?
নীতু আবারো খিলখিল করে হেসে উঠল।
চা দেয়া হয়েছে বারান্দায়। শাহানা একা অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যা নামছে ঘন হয়ে। টেবিলে কেরোসিনের বাতি আছে কিন্তু নেভাননা। মোহসিনকে আসতে দেখে শাহানা হাসল। মোহসিন বলল, কেমন আছ হার হাইনেস?
ভাল।
চোখের কোণে কালি, মুখ শুকনো। কি ব্যাপার বল তে? শরীর ভাল তো?
ডাক্তারকে কখনো জিজ্ঞেস করতে নেই শরীর ভাল কি-না।
সরি। তুমি যে একজন ডাক্তার মনেই থাকে না।
শাহানা চা ঢালছে। মোহসিন বলল, শুধু চা দিচ্ছ? প্রচণ্ড খিদে লেগেছে।
খিদে লাগলেও উপায় নেই। দাদাজানের নির্দেশ–বিকেলে তোমাকে যেন কিছু না দেয়া হয়। দুপুরে কিছু না খাওয়ায় উনি রেগে আছেন। তাঁর কাতল মাছের গতি হয়নি।
রাতে গতি হবে। কাতল মাছের দুঃখিত হবার কিছু নেই।
শাহানা হাসতে হাসতে বলল, রাতে অন্য মাছ।
সে কি!
রাজবাড়ির কাণ্ডকারখানা অন্য রকম।
সিগারেট খাওয়া যাবে তো? না-কিবিগারেট খেতে দেখলে তোমার দাদাজান রাগ করবেন?
রাগ করবেন না, খাও।
মোহসিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মিতু আমাকে প্রায় জোর করে পাঠিয়েছে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া। মিতুর ধারণা, তোমাকে এই মুহূর্তে গ্রেফতার করে নিয়ে না গেলে তুমি আর যাবে না, থেকে যাবে।