নীতু লাফিয়ে বজরায় উঠে চেঁচিয়ে বলল, মিতু আপা কোথায়?
মোহসিন বলল, তোমার মিতু আপা আসেনি। আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাদের নিয়ে যাবার জন্যে।
আপনি কেমন আছেন মোহসিন ভাই?
ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
আমি ভাল।
তোমার আপা, সে কেমন আছে?
খুব ভাল আছে। সমানে ডাক্তারি করে বেড়াচ্ছে।
ঘাটে যে বুড়ো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই কি তোমার দাদা।
হুঁ। দারুণ রাগী। নেমেই আপনি কিন্তু পা ছুঁয়ে উনাকে সালাম করবেন।
আর কি করতে হবে?
সানগ্লাস খুলে ফেলুন। দাদাজন খুব প্রাচীন ধরনের মানুষ। সানগ্লাসকে তারা অভদ্রতা মনে করেন।
ইরতাজুদ্দিন ছেলেটির ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। সে তার কাছে এসেই চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলেছে–নিচু হয়ে কদমবুসি করেছে। ইরতাজুদ্দিন স্পষ্ট গলায় বললেন, কেমন আছ মোহসিন?
ভাল। খুব ভাল।
রাস্তায় অসুবিধা হয়নি তো?
জ্বি-না। শুধু নৌকা যখন হাওড়ে পড়েছে তখন ভয় পেয়েছি। একেবারে সমুদ্রের মত ঢেউ।
তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। বৃদ্ধ মানুষের নিমন্ত্রণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মিতু এল না কেন?
ওর কি জানি একটা পরীক্ষা। ও ফ্রেঞ্চ শিখছে–তারই ডিপ্লোমা পরীক্ষা।
বাঙালী মেয়ের ফ্রেঞ্চ শেখার দরকার কি? এখন ফ্রেঞ্চ শেখাটাই ফ্যাশন না-কি?
মোহসিন হাসল। বুড়ো ভদ্রলোককে যতটা প্রাচীনপন্থি বলে নীতু ভয় দেখিয়েছে ততটা বোধ হয় না।
ইরতাজুদ্দিন বললেন, শহরে থেকে অভ্যাস, গ্রামের বাড়িঘর তোমার পছন্দ হবে কিনা কে জানে। এসো মোহসিন, এসো।
বাড়ি দেখে মোহসিন হকচকিয়ে গেল। এ তো ছোটখাট প্যালেস। কাঠের এত বড় দোতলা বাড়ি বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি আছে কি-না তার সন্দেহ হল। নীতু তাকে। বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে–
এটা হচ্ছে নামাজঘর। ঐ যে ছোট্ট পাটিটা দেখছেন ঐ টা হাতীর দাঁতের পাটি। ঐ যে ব্ল্যাক দেখছেন–র্যাক ভর্তি কোরান শরীফ। এর মধ্যে একটা কোরান শরীফ আছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিজের হাতের লেখা।
সত্যি?
অবশ্যই সত্যি। আসুন আপনাকে লাইব্রেরি ঘর দেখাই। লইব্রেরি ঘরজেখলে আপনার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, এত বড় লাইব্রেরি কিন্তু বাচ্চাদের কোন বই নেই।
তোমার জন্যে তো দুঃখেরই। প্রতিদিন তিনটা করে বই নাপেড়লে তো তোমার ঘুম হয় না। ভাল কথা, শাহানা কোথায়?
কে জানে কোথায়। ঘুরছে মনে হয়। কোথায় ঘুরছে?
গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপার সুতিহঠন রোগ হয়েছে। সকালে নাশতা খেয়ে হাঁটতে বের হয়–দুপুরে আর্জে)প্রথম দিকে দাদাজান একা বেরুতে নিষেধ করেছিলেন। এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যার করে নেয়া হয়েছে।
আসুন, লাইব্রেরিটা দেখবেন না?
খানিকক্ষণ পরে দেখলে কেমন হয় নীতু? খুব ক্লান্ত লাগছে–সাবান মেখে গোসল সেরে চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব। তারপর তুমি যা দেখাবে তাই দেখব। গোসলের জন্য কেউ কি আমাকে একটু গরম পানি করে দিতে পারবে?
হ্যাঁ পারবে।
আমি কোন ঘরে থাকব একটু দেখিয়ে দাও।
আপনি থাকবেন দোতলায়। আসুন ঘর দেখিয়ে দেই।
মিতু তোমার জন্যে গল্পের বই দিয়ে দিয়েছে, চকলেট দিয়ে দিয়েছে। গরমে চকলেট গলে গেছে বলে আমার ধারণা।
চিঠি দেয়নি?
হ্যাঁ, চিঠিও দিয়েছে। এসো তোমাকে সব দিয়ে দিচ্ছি।
আপনি কি গোসলের আগে চা খাবেন।
শাহানার ক্ষত সেকেন্ডে সেকেন্ডে চা খাওয়ার অভ্যাস আম্মার নেই। আমি গোসল করেই শুয়ে পর। আঁটি বাঙালীর মত সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুব।
সে কি। দুপুঝে খাবেন না।
উহুঁ, ঠিক একনার সময় আম্মি সঙ্গে করে আনা স্যান্ডউইচ খেয়েছি, পনীর খেয়েছি, আপেল খেয়েছি। কাজেই আামার দুপুরের মিল অফ।
শুনালে দাদাজানোর খুব মন খারাপ হবে। আপনার কথা ভেবেই দাদাজান রাক্ষস সাইজের এক কাতালা মাছ এনেছেন।
কোন উপায় নেই নীতু। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি কঠিন নিম্ম মেনে চলি। আমার উপর দায়িত্ব হল আমার দাদাজানকে এটা বুঝিয়ে বলা। কলতে পারবে না?
হুঁ পারব।
তুমি খুব চমৎকার একটা মেয়ে নীতু। খ্যাংক য়্যু ফর অল দ্যা হেল্প।
শাহানা বাড়িতে ফিরল দুপুর পার করে। তার জন্যে না খেয়ে ইরতাজুদ্দিন সাহেব এবং নীতু দুজনই অপেক্ষা করছিল। শাহানা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি কিছু খাব না দাদাজান। আপনারা খেয়ে নিন।
ইরতাজুদ্দিন বললেন, খাবি না কেন?
ইচ্ছা করছে না।
শরীর খারাপ করেনি তো?
না, শরীর ভাল আছে।
মুখ এত শুকনা লাগছে কেন?
রোদে রোদে ঘুঝেছি এই জন্যেই মুশুকনা লাগছে।
কিছুই খাবি না?
না। তবে আপনার বিখ্যাত পেঁপে একটু খেতে পারি।
নীতু বলল, তোমার জন্যে সুসংবাদ আছে আপা। মোহসিন ভাই এসেছেন। গোসল করে তাঁর ঘরে ঘুমুচ্ছেন। সন্ধ্যার আগে তাঁকে ডাকা যাবে না।
মিতু আসেনি?
না, চিঠি পাঠিয়েছে। তোমার টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি।
শাহানা তার নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। ইরতাজুদ্দিন লক্ষ্য করলেন, মোহসিন এসেছে এই সংবাদে তার নাতনীর চেহারায় কোন পরিবর্তন হয়নি। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ শুধু পড়েছে। বিরক্ত হলেই মানুষের কপালের চামড়া এভাবে কুঁচকে যায়। মেয়েটার কি কোন সমস্যা হয়েছে?
বাটি ভর্তি পেঁপে দিয়ে গেছে। পেঁপের সঙ্গে এক গ্লাস দুধ, এক গ্লাস পানি। শাহানা তার কোন কিছুই স্পর্শ করল না। সে মিতুর চিঠি পড়ছে। যে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সে পাঠ্যবই পড়ে ঠিক একই মনোযোগের সঙ্গে সে মিতু চিঠি পড়ছে। মিতুর হাতের লেখা কাঁচা। প্রচুর বানান ভুল–কিন্তু চিঠিটা খুব গোছানো—