তুই চলে যা নীতু। আমি একা একা ঘুরব।
চলে যাব?
হ্যাঁ চলে যা। ওরা আসবে, ওদের জন্যে অপেক্ষা কর।
তুমি বাড়ি ফিরবে কখন?
দুপুরের আগেই ফিরব।
ওরা যদি চলে আসে তোমাকে খবর পাঠাব?
না।
নীতু খুশি মনে চলে যাচ্ছে। শাহানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা খুব সুন্দর। ছোট্ট সুন্দর একটা দীঘি। গ্রামের দীঘির চারদিকে সাধারণত নারকেল গাছ কিংবা তালগাছ থাকে। এই দীঘিটার চারদিকে কদমগাছ। কদমফুল ফুটে আলো হয়ে আছে। অপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু করা যায় না। খুব রুচিবান কোন মানুষ ভেবেচিন্তে গাছগুলি লাগিয়েছেন। কে সেই রুচিবান মানুষ?
শাহানা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে কদমগাছ দেখছে। এই মুহূর্তে কেউ যদি তাকে বলে? পৃথিবীর সবচে সুন্দর ফুলের নাম কি? সে অবশ্যই বলবে–কদম।
আম্মাজি!
শাহানা চমকে তাকাল। বৃদ্ধ একজন মানুষ কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিনয়ে প্রায় নুয়ে পড়েছে। মুখে আনন্দের হাসি।
কি দেখেন আম্মাজি?
কদমগাছ দেখি। দীঘির চারদিকে এমন সুন্দর করে কে কদমগাছ লাগিয়েছে বলতে পারেন?
কেউ লাগায় নাই আম্মজি, আপনাআপনি হইছে?
সত্যি?
জ্বি।
এই গ্রামে কি আরো দীঘি আছে?
জি-না। একটাই দীঘি?
দীঘিটার নাম কি?
কোন নাম নাই আজি–আফনে একটা নাম দেন, আমরা হেই নামে ডাকব।
আমি একটা নাম দিলেই সবাই এই নামে ডাকবে?
অবশ্যই ডাকব। এই গেরামের মানুষ যে আফনেরে কত ভাল পায় এইটা আফনে জানেন না।
শাহানা লজ্জিত গলায় বলল, আমি তো আপনাদের জন্য তেমন কিছু করিনি। দশ বার জন রোগি দেখেছি। সেটা তো আমি দেখবই। আমি তো আপনাদের গ্রামেরই মেয়ে। ডাক্তার হয়েছি। রোগি দেখা তো আমার পেশা।
আফনের রোগ দেখা আর অন্যের রোগি দেখার মইধ্যে আসমান-জমিন ফারাক আছে।
শাহানা হাসছে। সে এখনো তাকিয়ে আছে কদমগাছগুলির দিকে–ইস, কি সুন্দর ফুল!
আম্মাজি, ফুল পাইরা দিব?
না। গাছের ফুল গাছেই থাক। আচ্ছা ঠিক আছে, দিন তো কয়েকটা ফুল। আপনি তো গাছে উঠতে পারবেন না–ফুল পাড়বেন কি ভাবে?
আম্মাজি, আমি পাইরা পাঠাইয়া দিমু।
আচ্ছা?
শাহানা হাঁটছে। গ্রামের বৌ-ঝিদের কৌতূহলী দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছেন কিন্তু কেউ তাকে বিরক্ত করছে না। হাঁটতে হাঁটতে শাহানার মনে হল—এই গ্রামের মানুষগুলি এত হত দরিদ্র কেন? ঘরবাড়ির কি অবস্থা! আহা রে, একুটু কিছু যদি এই মানুষগুলির জন্যে করা যেত!
একটা বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। ব্যাকুল হয়ে ফুঁখিয়ে ফুঁপিয়ে কে কাঁদছে। শাহানা থমকে দাঁড়াল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির ভেতর থেকে ঘোমটা দেয়া একজন বৃদ্ধ মহিলা বের হয়ে এলেন।
বৃদ্ধ গাঢ় আন্তরিকতার স্বরে বললেন, আমার বাড়ির সামনে আইস্যা দাঁড়াইছেন কি যে খুশি হইছি আম্মা।
শাহানা বলল, কাঁদছে কে?
আমার ছেলের বৌ কানতাছে আম্মা।
কেন?
আপনেরে দেইখ্যা কানতাছে।
আমাকে দেখে কাঁদছে কেন?
বউটার বড় ছেলেটা গত মাসে চাইর দিনের জ্বরে মারা গেছে। আম্মা, আপনেরে দেইখ্যা এই জন্যে কানতাছে। যদি এক মাস আগে আইতেন, ছেলেটা বাঁচত।
শাহানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বউটার হাহাকার সহ্য করা যায় না। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বিনিয়ে বিনিয়ে বলছে–আল্লাহ, রাজবাড়ির কন্যারে তুমি আইজ কেন পাঠাইলা? তুমি কেন এক মাস আগে পাঠাইলা না!…
শাহানার চোখে পানি এসে গেল। আর জন্যে সে লজ্জিতও হল না। শাড়ির আঁচিলে চোখ মুছে বলল, আপনি আপনার বৌমাকে বুঝিয়ে বলবেন–জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহ ঠিক করে রাখেন। মানুঝের কিছুই করণীয় নেই।
শাহানা জানে সে ভুল কখা বলেছে। মানুষের অনেক কিছুই করণীয় আছে–মানুষের আছে রোগব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তিশালী সব হারিয়ার। মৃত্যুর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে মানুষ আজ উঁচু গলায় বলতে পারে–বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।
বৃদ্ধা তুললে, মা, আপনি একটু ঘরে পা দিবেন না?
জ্বি-না। আপনার বউমার কান্না শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। দেখছেন না আমার নিজের চোখে পানি এসে গেছে।
আম্মাগো, বড় খুশি হইছি, আপনি যে আমার বাড়ির সামনে দাঁড়াইছে–বড় খুশি হইছি। এখন কই যাইবেন আম্মা?
কোথাও যাব না, পথে পথে হাঁটব।
শাহানা কিছুক্ষণ পথে পথে হাঁটল–তারপর উপস্থিত হল মতির বাড়িতে। মতির আবার জ্বর এসেছে। সে কুণ্ডলি পাকিয়ে নোংরা বিছানায় শুয়ে আছে। শাহানাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল।
শাহানা বলল, আজ আমার মনটা খুব খারাপ। আপনি আমাকে একটা আনন্দের গান গেয়ে আমার মন ভাল করে দিল। আমি আমার গান শুনতে এসেছি।
মতি লাল, আনন্দের গান শুইনা মনের দুঃখ দূর হয় না। মনের দূর করতে দুঃখের গান লাগে।
বে, একটা দুঃখের গান গান।
মতি সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল–
কে পরাইল আমার চউক্ষে কলংক কাজল?
কুসুম সকালে এসে মতির জ্বর দেখে গিয়েছিল।
সে এক বাটি সাগু নিয়ে ঘরে ঢুকে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখল–রাজবাড়ির মেয়ে চৌকিতে পা তুলে ধ্যানী মুর্তির মত বসে আছে। মতি মিয়া চোখ বন্ধ করে গলা ছেড়ে গাইছে–কে পরাইল আমার চউক্ষে কলংক কাজল।
কুসুম কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।
মোহসিন একাই এসেছে
মোহসিন একাই এসেছে। তার চোখে সানগ্লাস, গায়ে হালকা নীল রঙের টি শার্ট। পরনের প্যান্টের রঙ ধবধবে শাদা, পায়ের জুতা জোড়াও শাদা চামড়ার। সে বজরার ছাদে পাতা চেয়ারে বসে আছে।
নীতু দেখতে পেয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নামছে। ঘাটের মাথায় ইরতাজুদ্দিন দাঁড়িয়ে। তিনি কৌতূহলী চোখে ছেলেটিকে দেখছেন। মানুষের সবচে বড় পরিচয় তার চোখে। ছেলেটি তার চোখ কালো চশমায় ঢেকে রেখেছে, তারপরেও ইরতাজুদ্দিন বললেন, বেশ ছেলে তো!