আমি একটা কিছু দেখতে পাচ্ছি।
কি দেখতে পাচ্ছিস?
একটা লোক দেখতে পাচ্ছি আপা। দুষ্টলোক। লোকটা বিড়ি খাচ্ছে। আর তার গোঁফ আছে।
অন্ধকারে দেখছিস কি ভাবে?
ঐ দেখ বিড়ির আগুন জ্বলছে, নিভছে। মুখে নিয়ে যখন টানে তখন বিড়ির আলোয় তার ঠোঁট আর গোঁফ দেখা যায়–দেখতে পাচ্ছ?
হুঁ। বিড়ি না হয়ে সিগারেটও হতে পারে। বিড়ি যে বুঝলি কি করে?
অন্ধকারে সিগারেটের আগুন কেমন হয় আমি জানি–এটা সিগারেটের আগুন। আপা, আমরা এখন কি করব?
আমরা বসে বসে একটা লোকের বিড়ি খাওয়া দেখব।
আর কিছু করব না?
উহুঁ।
আপা, লোকটা কিন্তু আমাদের দিকে আসছে।
আসুক।
লোকটার মতলব ভাল না আপা।
কি করে বুঝলি মতলব ভাল না?
হাঁটা দেখে বুঝছি। দেখ না কেমন থেমে থেমে আসছে। মতলব ভাল হলে থেমে থেমে আসত না।
আজকাল তুই ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস বেশি পড়ছিস। ডিটেকটিভ বই বেশি পড়লে আশেপাশের সবাইকে চোর বা ডাকাত মনে হয়। ভূতের বই বেশি পড়লে প্রতিটি অন্ধকার কোণে একটা করে ভূত আছে বলে মনে হয়।
লোকটা আমাদের দেখতে পেয়েছে আপা।
স্টেশন ঘরে হারিকেনের আলো আছে। দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ নেই।
দেখ আপা, লোকটা আগের বিড়ি ফেলে দিয়ে নতুন করে বিড়ি ধরিয়েছে। বলেছিলাম না–দুষ্টলোক।
দুষ্টলোক-টোক না, চেইন স্মোকার। এ কেহ দিন বাঁচবে না।
বাঁচবে না কেন?
চেইন স্মোকাররা বেশি দিন বাঁচে না। ওদের আর্টারিতে চর্বি জমে আর্টারি সরু হয়ে যায়। তারপর হয় হার্ট এ্যাটাক…। আর্টারি কি জানিস তো?
জানি। রক্তবাহী শিরা।
ভয়ে নীতুর বুক কাঁপছে, কারণ লোকটার মুখ এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। টিকিট ঘরের ফুটো দিয়ে সে তাকাচ্ছে। লোকটার ঠোঁটে গোঁফ নেই। সে আসলে ভুল দেখেছে। বিশ্রী গোলাকার একটা মুখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে লম্বা চুল। লোকটা সর্দি-বসা গলায় বলল, মাস্টার সাহেব কই?
নীতু বলল, মাস্টার সাহেব কোথায় আমরা জানি না। আপনি কে?
আপনারা কে?
আমরা কে তা দিয়ে আপনার কোন দরকার নেই।
যাবেন কোথায়?
তা দিয়েও আপনার দরকার নেই।
আমার নাম মতি। মাস্টার সাব আমারে চিনে।
উনি চিনলে উনার সংগে কথা বলবেন, এখন দয়া করে আমাদের বিরক্ত করবেন না।
নীতুর টকটক করে কথা বলা শুনে শাহানা মনে মনে হাসছে। ভয়ে এই মেয়ে মরে যাচ্ছে অথচ কেমন কথা শুনাচ্ছে। নীতুর কথায় লোকটি হকচকিয়ে গেছে–বোঝাই যাচ্ছে। সে কথা বন্ধ করলেও সরে গেল না। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
নীতু বলল, জানালার সামনে বাতাস বন্ধ করে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সরে দাঁড়ান। আমাদের অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে।
লোকটা তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়াল। তবে তাকিয়ে রইল শাহানার দিকে।
নীতু ফিস ফিস করে বলল, আপা দেখ, লোকটা আরেকটা বিড়ি ধরিয়েছে। আপা দেখ, কি ভাবে সে তোমাকে দেখছে। চোখে পলক ফেলছে না।
রূপবতী একজন তরুণী গ্রামের স্টেশন ঘরে বসে আছে। তাকে তো অবাক হয়ে দেখারই কথা।
আপা সে এখন যাচ্ছে।
গুড।
বদমাশ সঙ্গী-সাথীদের খবর দিয়ে আনবে না তো? দেখো আপা, কি বিশ্রীভাবে লোকটা যাচ্ছে।
লোকটা সাধারণ মানুষের মতই যাচ্ছে–তুই ভয়ে আধমরা হয়ে আছিস বলে সাধারণ হাঁটাই তোর কাছে ভয়ংকর হাঁটা বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া ভাললোকের হাঁটা এবং মন্দলোকের হাঁটাতে কোন বেশ-কম নই। ভাল-মন্দ মানুষের মনে, হাঁটায় নয়।
কি লম্বা চুল দেখ না। লম্বা চুলের মানুষ ভাল হয় না।
রবীন্দ্রনাথেরও লম্বা চুল ছিল। উনি কি মন্দ?
তুমি সবসময় স্কুল টিচারের মত কথা বল–আমার ভাল লাগে না আপা। যাদের জ্ঞান কম তারাই সব সময় জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে।
জ্ঞানীরা কথা বলে না?
না, ভরা কলসির শব্দ হয় না।
জ্ঞানী যদি কোন কথাই না বলে তাহলে আমরা বুঝব কি করে সে জ্ঞানী? তার যে জ্ঞান আছে–সেটা বুঝানোর জন্যে তো তাকে কথা বলতে হবে। ভরা কলসির শব্দ হয় না–এটাও তো তুই ঠিক বললি না। ভরা কলসিরও শব্দ হয়, তবে অন্য। রকম শব্দ। বুঝতে পারছিস?
পারছি। তুমি নিজেকে কি মনে কর আপা? ভরা কলসি?
শাহানা জবাব দিল না। হাসল। নীতুকে রাগিয়ে দিয়ে সে এখন খুব মজা পাচ্ছে। খুব রেগে গেলে নীতু হাত-পা ছুঁড়ে কাদতে শুরু করে, সেই দৃশ্য খুব মজার। নীতুর চোখ-মুখ যেমন দেখাচ্ছে মনে হয় হাত-পা ছুঁড়ে কান্না শুরুর বেশি বাকি নেই।
আপা!
হুঁ।
লোকটা কিন্তু চলে যায়নি–ঐ দেখ দাঁড়িয়ে আছে।
থাকুক দাঁড়িয়ে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ভেতর যাবে কি ভাবে?
ভয় লাগছে তো আপা।
গুন গুন করে গান গায় গান গাইলে ভয় কাটে।
সব সময় ঠাট্টা কর কেন?
আচ্ছা আর ঠাট্টা করব না।
আপা, লোকটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কি বিশ্রী চেষ্টা করছিল লক্ষ করেছ?
না। আমি তোর মত ডিটেকটিভের চোখে সব লক্ষ্য করি না।
আপা, কোন লোকের কথা শুনে কি বলা যায় সে কি করে তার পড়াশোনা কতদূর?
না, বলা যায় না। আমাদের মেডিক্যাল কলেজে সার্জারির একজন প্রফেসর ছিলেন–খাস নেত্রকোনার গ্রাম্য ভাষায় কথা বলো মুখ ভর্তি করে পান খান। পানের কস গড়িয়ে গড়িয়ে তার শার্টে পড়ে।
ছিঃ!
তুই ছিঃ বললে হবে কি, উনি পৃথিবীর সেরা সার্জনদের একজন। চোখ বেঁধে দিলেও তিনি নিখুঁত অপারেশন করতে পারেন।
তিনি কি চোখ বেঁধে কখনও অপারেশন করেছেন?
না।
আপা, দেখ ঐ লোকটা নাক ঝাড়ছে।
নাকে সর্দি জমেছে নাক ঝাড়ছে–এটা তো নীতু দেখার মত দৃশ্য না।
আমার গা ঘিন ঘিন করছে আপা।