আপনি-তুমির সমস্যা এড়িয়ে ভাববাচ্যে কথা বলা। তার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে গেছে। এই বয়সে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের আপনি বলতে ইচ্ছা করে না। আবার চট করে তুমিও বলা যায় না।
শাহানা বলল, আমরা সুখানপুকুর যাব। আপনি কি দয়া করে আমার ছোটবোনের পা ধোয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন? ওর শুচিবায়ুর মত আছে।
সুখানপুকুর কার কাছে যাওয়া হবে?
শাহানা হাসি হাসি মুখে বলল, সুখানপুকুরে আমাদের দাদার বাড়ি। দাদাকে দেখতে যাব।
আপনার দাদার নাম কি ইরতাজুদ্দিন?
জি।
ও, আচ্ছা আচ্ছা। আপনারা আসুন, ভেতরে এসে বসুন। আচ্ছা দাঁড়ান, তার আগে পা ধোয়ার ব্যবস্থা করি।
মনসুর আলি নিজের চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। নীতু ফিস ফিস করে বলল–বিখ্যাত দাদা থাকার অনেক সুবিধা, তাই না আপা?
হুঁ। এখন আর আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।
মনে হয় না।
এই ভরসাতেই তুমি এত নিশ্চিত হয়েছিলে?
শাহানা হাসল।
মনসুর আলি সাহেবের মুখে কোন হসি নেই। রাত বারটা একুশ মিনিটে নাইন আপ পার করে দেবার পর ভোর নটা পর্যন্ত তার নিশ্চিন্ত থাকার কথা ছিল। সুন্দর বৃষ্টি নেমেছে। আরামের ঘুম ঘুমানো যাবে। এখন মনে হচ্ছে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। পয়েন্টসম্যান বদরুলকে খুঁজে বের করতে হবে। কোথাও নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। মেয়ে দুটির সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আছে নিশ্চয়ই। ভং ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে। সামান্য স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বললে তাদের অপমান হবে। এদের চা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। বদরুলকে পাঠিয়ে চা আনাতে হবে। এরা এইসব চা খাবে না। এক চুমুক দিয়ে রেখে দেবে। তারপরও দিতে হবে। সুখানপুকুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কাঁচা রাস্তা। হাঁটু পর্যন্ত ডেবে যাবে কাদায়। গরু গাড়ি পাওয়া গেলে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়া যাবে। এত রাতে পাওয়া যাবে কি না কে জানে।
মনসুর আলি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন মেয়ে দুটির সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আসেনি। এরা একাই এসেছে। সারা স্টেশন খুঁজে বদরুলকে পেলেন না। হারামজাদা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফাজিলদের একজন। বাড়িতে গিয়ে ঘুমুচ্ছে। চায়ের খোঁজে তাকেই যেতে হবে। তার হঠাৎ মনে হল, তিনি সঙ্গে ছাতা আনেননি। এম্নিতেই গায়ে জ্বর। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাৎ বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে। জ্বর আরো বাড়বে, ধরবে নিওমোনিয়া।
নীতু বলল, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
মনসুর আলি বললেন, না না, ব্যস্ত হচ্ছি না তো। ব্যস্ত হবার কি আছে? আপনারা চা খাবেন?
নীতু বলল, পরে খাব। আগে পা খোব। এখানে টিউবওয়েল আছে না?
ও আচ্ছা হ্যাঁ–পা। অবশ্যই। অবশ্যই। টিউবওয়েল আছে। টিউবওয়েল থাকবে না কেন?
বলেই মনসুর আলির মনে হল–টিউবওয়েল আছে ঠিকই, ওয়াসার হয়ে গেছে বলে পানি উঠে না। এখন এই মেয়েকে পুকুরে নিয়ে যেতে হবে। স্টেশনের কাছেই পুকুর–বেশি হাঁটতে হবে না। তবে ঘাট নেই পুকুর। ঝুম করে এই মেয়ে পানিতে পড়ে গেলে ষোলকলা পূর্ণ হয়।
মনসুর আলি বিব্রত গলায় বললেন, টিউবওয়েলটা বোধহয় নষ্ট–আপনাকে কষ্ট করে একটু পুকুরে যেতে হবে।
আমার কোন কষ্ট হবে না। চলুন। গা ঘিন ঘিন করছে। আর শুনুন, আমাকে তুমি করে বলুন। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি।
মা, তুমি সাঁতার জান তো?
নীতু বিস্মিত হয়ে বলল, পা ঘোয়ার জন্যে সাঁতার জানতে হবে কেন?
না, এম্নি বলছি।
আমি সাঁতার জানি না।
সাঁতার জানা ভাল। কখন দরকার হয় কিছু তো বলা যায় না।
মনসুর আলির মনে হল তার জ্বর বেড়েছে। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে দুটি বড়ই সুন্দর। তার নিজের মেয়েও সুন্দর–শুধু দাঁত উচু বলে বিয়ে হচ্ছে না। আজকাল না-কি উঁচু দাঁত ঠিক করা যায়। নিশ্চয়ই বিস্তর টাকার দরকার হয়। মেয়েটার দাঁত ঠিক করলে এই মেয়ে দুটির মতই সুন্দর হত।
শাহানা এবং নীতু টিকিট ঘরে বসে আছে। মনসুর আলি গেছেন তাদের জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করতে। চায়ের ব্যবস্থা করবেন, সুখানপুকুরে যাবার ব্যবস্থা করবেন। বদরুল হারামজাদাকে খুঁজে বের করবেন। হারামজাদাটাকে সবসময় পাওয়া যায়–শুধু কাজের সময় পাওয়া যায় না।
নীতুর এখন মজাই লাগছে। তার ভয় কেটে গেছে। স্টেশন মাস্টার সাহেব এখন আর তাদের কোন ঝামেলা হতে দেবেন না। টিকিট ঘরের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে ভদ্রলোক যে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলেন এতে নীতু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। এখন যদি কেউ এসে টিকিট চায় তাহলে তারা কি করবে? হঠাৎ ঘরে টক টক শব্দ হতে শুরু করল। নীতু বলল, শব্দ কিসের আপা?
শাহানা সহজ গলায় বলল, টেলিগ্রাফ এসেছে। মোর্স কোডে খবর দিচ্ছে।
কি খবর?
ভালমত না শুনে বলতে পারব না। কোড এনালাইসিস করতে হবে।
কি ভাবে এনালাইসিস করবে?
টরে টক্কা হল A, টক্কা টরে টরে টরে হল B, টক্কা টরে টক্কা টরে হল C, D টক্কা টরে টরে…।
তুমি এত সব জানলে কি ভাবে?
বই পড়ে জেনেছি।
বই তো আমিও পড়ি, আমি তো কিছু জানি না…
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট ঘরের হারিকেন দপ দপ করতে লাগল। নিভি নিভি করেও শেষ পর্যন্ত নিভল না। হারিকেন নিজেকে সামলে নিল। আধো অন্ধকার ঘরে টেলিগ্রাফের টরে টক্কা শব্দ হচ্ছে। বাতাসে জানালা ভেদ করে বৃষ্টির ছাট আসছে।
আপা।
হুঁ।
নীতু থমথমে গলায় বলল, বাইরে একটু তাকিয়ে দেখবে আপা?
প্রয়োজন হলে দেখব। প্রয়োজন বোধ করছি না। বাইরে তাকিয়ে কিছুই দেখা যাবে না। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।