একটা মানুষ মারা যাইতেছে।
কপালে মৃত্যু থাকলে মারা যাবেই। ডাক্তার গুলে খাওয়ালেও কিছু হবে না। গ্রামের মানুষের আপনার নাতনীর উপর দাবি আছে স্যার। সেও তো এই গ্রামেরই মেয়ে…
ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, যুক্তিতর্ক শুরু করলা কেন? এটা তো যুক্তিতর্কের বিষয় না।
আমি উনারে নিজে একটু বইল্যা দেখি–উনি যদি যাইতে চান… কাকী বঁচবো না আমি জানি। তবু মনের শান্তি। সে বুঝবো তাকে বাঁচানোর চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই।
এটা বুঝে লাভ কি?
মতি চুপ করে রইল। ইরতাজুদ্দিন বললেন–খামাখা দাঁড়িয়ে থাকবে না। চলে যাও। আর শোন–খালি পায়ে আমার বাংলোঘরে উঠবে না।
মতি তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। ইরতাজুদ্দিন কঠিন গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
মতি বলল, আমি উনার সঙ্গে কথা না বইল্যা নড়ব না। উনার উপর আমার দাবি আছে।
তার উপর তোমার দাবি আছে মানে? বর্বরের মত কি বলছ তুমি? কি করছ তুমি?
মতি চুপ করে আছে। আসলেই তো, তার কিসের দাবি! বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লগি ঠেলে সে এদের নিয়ে এসেছে। এতে খানিকটা দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়–কিন্তু তার জন্যে সে পারিশ্রমিক নিয়েছে। পঞ্চাশটা টাকা না নিলে দাবি থাকত। এখন নেই। মতি বলল, উনি যদি নিজের মুখে না বলেন তাইলে আমি চইল্যা যাব।
সে না বললে তুমি যাবে না?
না।
দাঁড়িয়ে থাকবে এখানে?
জ্বি।
তুমি যে এই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাগল সেটা তুমি জান?
ছাগল হই আর না হই–আমি উনার সঙ্গে কথা না বইল্যা নড়ব না।
ইরতাজুদ্দিন অনেক কষ্টে রাগ সামলে নাতনীকে আনতে গেলেন।
শাহানা শান্ত মুখে এসে দাঁড়াল। মতি বলল, বড় বিপদে পইরা আসছি। পরাণ কাকার স্ত্রী মরতে বসছে। সন্তান প্রসব হইতাছেনা। আপনি কি তারে একটু চউখের দেখা দেখবেন?
শাহানা তার দাদাজানকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বলল, অবশ্যই দেখব।
মতি ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে
মতি ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে। তার পেছনে পেছনে একজন মেয়ে যাচ্ছে–সে তার মত ছুটতে পারবে কিনা এদিকে তার খেয়াল নেই। শাহানা অবশ্যি মতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই ছুটছে। একবার শুধু সে আকাশ দেখল–আকাশ ঘন কালো। এরকম কালো আকাশ সচরাচর দেখা যায় না।
শাহানা বলল, রোগির অবস্থা কি খুব খারাপ?
মতি ঘাড় না ফিরিয়েই বলল, জ্বি! মারা যাইতেছে।
শাহানার মনে হল মৃত্যুর জন্যে দিনটি সুন্দর। আকাশ জোড়া মেঘ। বর্ষার অপূর্ব সকাল। তার নিজের মৃত্যুর সময় প্রকৃতি কেমন থাকবে? সে কি রাতে মারা যাবে, না দিনে? সবচে ভাল হত পূর্ণিমার রাতে মরতে পারলে–একটা গান আছে না–চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। মতি মিয়া কি গানটা জানে?
শাহানা সহজ গলায় বলল, শুনুন, আপনি কি এই গানটা জানেন–ঐ যে চান্নি পহর রাইতে যেন আমার মরণ হয়?
মতি অবাক হয়ে পেছন ফিরল–কি আশ্চর্য, এই সময় কোন মেয়ের মাথায় গানের কথা আসে?
গানটা জানেন না, তাই না?
জি-না।
খুব সুন্দর গান। আমার গলায় সুর নেই। সুর থাকলে আপনাকে শুনাতাম। রোগির বাড়ি কত দূর?
ঐ যে দেখা যায়।
শাহানার মনে হল রোগির বাড়ি আরেকটু দূর হলে ভাল হত। কেন জানি এই ভোরবেলায় ছুটতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ বয়স কমে গিয়ে সে নীতুর বয়েসী হয়ে গেছে।
পরাণের উঠোনে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের আনুষদের এই এক অভ্যাস–বিপদে তেমন সাহায্য করতে পারে না কিংসাই পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা কৌতূহলী হয়ে দেখছে শাহানাকে। বাচ্চা একরীমেয়ে–জটিল ও ভয়াবহ বিপদে এই মেয়ে কি করবে?
শাহানা সবার কৌতূহলী চোখের উপর ঘরে ঢুকল।
ঘরে তেমন আলো নেই। আকাশ মেঘলা থাকায় আলো স্লান ও বিবর্ণ। গ্রামের বাড়িগুলির জানালা থাকে না। একটামাত্র দরজা–সেই দরজা বন্ধ। ঘর অন্ধকার। একটা হারিকেন জ্বলছে, একটা কুপি জ্বলছে। হারিকেন ও কুপির ক্ষীণ আলো অন্ধকার কাটাতে পারছে না।
খোদেজার মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে শাহানার দিকে। কি মিষ্টি কিশোরীদের মত মুখ! কি মায়া মায়া টানা চোখ। এই মেয়ের দিকে তাকালেই মনে হয় এই মেয়ে পৃথিবীর কোন জটিলতাই জানে না। কিন্তু মেয়েটি হাঁটু গেড়ে দূর্গার চৌকির কাছে বসেছে। তার বসার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে কি করবে বা কি করবে না সে সম্পর্কে তার খুব পরিষ্কার ধারণা আছে। তার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই। মেয়েটি দূর্গার পেটে হাত রেখেই চমকে উঠল। তার চমকানি বলে দিচ্ছে সে তার কাজ জানে। শুধু যে জানে তাই না–খুব ভাল করে জানে। খোদেজার মা হঠাৎ খানিকটা ভরসা পেল। যুদ্ধক্ষেত্রে রণক্লান্ত সৈনিকের পাশে একজন তুখোড় যোদ্ধা এসে দাঁড়ালে ক্লান্ত যোদ্ধা যে ভরসা পায়–সেই ভরসা।
শাহানার হাত কাপছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। দুটাই খারাপ লক্ষণ; নার্ভ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নার্ভ ঠিক রাখতে হবে। এই পরিস্থিতিতে নার্ভ ঠিক রাখা কি সম্ভব? এই বিদ্যা যারা তাকে দিয়েছেন–তাঁরা কি নার্ভ ঠিক রাখতে পারতেন? পরিস্থিতি ভয়াবহ–শিশুটি যে পজিশনে আছে তাতে ডেলিভারি হবে না। সে চলে এসেছে বার্থ ক্যানেলের মুখে। সেখানে তার মাথা থাকার কথা–মাথা নেই। শিশুটি বার্থ ক্যানেলে আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। তার অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। মায়ের যে জরায়ু তাকে এতদিন আশ্রয় দিয়েছে সেই জরায়ু এখন তাকে ঠেলে বের করে দিতে যাচ্ছে।
অসহায় শিশু আটকা পড়ে গেছে। মা বলে শিশুটি মনে মনে হয়ত কাঁদছে। অচেতন মা শিশুর সেই কান্না শুনতে পাচ্ছেন না।