দূর্গা বলল, পুলাপান দুইটারে খবর দিয়া আনেন।
কেন?
অনেকদিন দেখি না, দেখনের ইচ্ছা করে।
আইচ্ছা, কাইল খবর দিব।
দূর্গা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল–আমার মনের মধ্যে কু ডাক ডাকতাছে। যদি ভাল-মন্দ কিছু হইয়া যায়–ক্ষমা দিবেন।
পরাণ এই কথার জবাব দিল না। হাঁ-হুঁ পর্যন্ত করল না। দূর্গা বলল, অভাব অনটনে সংসার চালাতে গিয়া নানান সময়ে আপনেরে কটু কথা বলছি। মন থাইক্যা বলি নাই–মুখে চইল্যা আসছে, বলছি।
পরাণ বলল, তুমি যেমন বলছ আমিও বলছি।
না, আপনে বলেন নাই। আপনি কোনদিনই কিছু বলেন নাই।
মুখে না বললেও মনে মনে হয়ত বলেছি।
না, মনে মনেও বলেন নাই। মানুষ যখন মনে মনে রাগ করে তখন তার চেহারা দেইখ্যা সেইটা বোঝা যায়। রাগ কইরা কত কটু কথা আপনেরে বলছি, তারপর অবাক হইয়া দেখছি আপনে মাথা নিচা কইরা হাসতাছেন। পুলাপানের মিটমিটাইন্যা হাসি। দেইখ্যা প্রত্যেকবার খুব শরম পাইছি। প্রত্যেকবার নিজেকে বলছি–দূর্গা, এমন একটা মানুষের সাথে তুই কটু কথা কস! তোর কি বিচার-বিবেচনা নাই?
পরাণ বলল, ঢোলটা বাইরে রইছে, নিয়া আসি। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে ভিজব।
ভিজুক। আপনে এইখানে বসেন। মন খুইল্যা দুর কথা কোনদিন আপনেরে বলতে পারি না–আইজ বলব।
বল।
কয়েকদিন খাইক্যা মনের মইধ্যে কু ডাকতাছে। ভাল-মন্দ যদি কিছু হয়…
কিছু হবে না। আপনে কি কইরা জানেন কিছু হবে না? আপনে মানুষটা দেবতার মত হইলেও আপনে তো আর দেবতা না।
দূর্গা কাদতে শুরু করেছে। আকাশে মেঘ ডাকছে। গুড়ু গুড় শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি বোধহয় নামবে। বৃষ্টির মধ্যে যে শিশুর জন্ম হয় সে হয় ভাগ্যবান। পরাণের আগের কোন ছেলেমেয়ের জন্মের সময় বৃষ্টি ছিল না—এবারের জন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসছে। পরাণ তার শরীরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করল।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে সুবল খোদেজার মাকে নিয়ে এল। বহুদিনের অভিজ্ঞ ধাই। শিশু প্রসবের পুরো ব্যাপারটা নিশ্চিন্তে তার উপর ছেড়ে দেয়া যায়। ঘরে পা দিয়েই সে যা করার অতি দ্রুত করে ফেলবে। গরম পানি, নাড়ি কাটার জন্যে কঞ্চির ধারাল খণ্ড, সেঁক দেয়ার জন্যে কাপড়।
সূরা ইয়াসীন পড়ে রোগির পেটে ফুঁ দিয়ে সে কাজকর্ম শুরু করে। হিন্দু মেয়ের পেটে সূরা ইয়াসীন পড়ে ফুঁ দেয়া যায় কি-না এই নিয়ে তার মনে সংশয় ছিল। এখন সেই সংশয়ও নেই–মায়ের পেটের শিশু মুসলমান। ভূমিষ্ট হবার পর–হিন্দুমুসলমানে ভাগাভাগি আসে। কাজেই পেটের সন্তানকে উদ্দেশ্য করে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা যায়।
খোদেজার মা চোখ বন্ধ করে সূরা ইয়াসীন পড়ে ফুঁ দিয়ে রাগী গলায় বলল, ব্যবস্থা তো কিছুই দেখি না। ঘর আন্ধাইর কইরা বইস্যা আছ। আন্ধাইর ঘরে জ্বীন ভূত নাচানাচি করে। আলো না থাকলে ফিরিশতা আসে না। খালি কুপি দিয়া হইব না। হারিকেন লাগব। সেঁকের ব্যবস্থা লাগব। নরম তেনা কই? চা খাওনের একটু ব্যবস্থা দেখ। রাইত জাগন লাগব। ঘুমে চউখ আসতাছে বন্ধ হইয়া।
খোদেজার মা কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাজে নেমে পড়ল। পরাণ এবং সুবল বসে রইল উঠোনে। সুবলের স্বভাবও তার বাবার মত–কথাবর্তা বলে না। সারাক্ষণই মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ভোররাতে খোদেজার মা কুপি হাতে উঠোনে নেমে এসে বলল, অবস্থা ভাল না। বাচ্চার মাথা উপরের দিকে। দূর্গারে সদর হাসপাতালে নেওন লাগব। অতক্ষণ বাঁইচ্যা থাকব বইল্যা মনে হয় না। আমার জ্ঞান-বুদ্ধির মইধ্যে যা ছিল করছি। আল্লাহ পাক জানেন আর আমার নবিজী জানেন, আমি চেষ্টার ত্রুটি করি নাই।
পরাণ হতভম্ব গলায় বলল, দূর্গা কি মারা যাইতাছে?
খোদেজা কিছু বলল না।
সদরে নিয়া যাব?
সদরে নিতে দুইদিন লাগব। অত সময় আমরার হাতে নাই। তারপরেও চেষ্টা কইরা দেখন যায়। সদরে যদি যান–আমিও সাথে যাব।
পরাণ উঠে দাঁড়াল। তার নিজের নৌকা আছে–সেই নৌকায় নেয়া যাবে না–ছই নাই। নৌকার জোগাড় দেখতে হবে। প্রথমেই খবর দিতে হবে মতিকে। মানুষের বিপদে-আপদে যে প্রথম ছুটে আসে সে মতি। সে পাশে থাকলে বুকে আপনাতেই হাতির বল চলে আসে।
টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। পরাণ ছুটে যাচ্ছে। সুবল বৃষ্টির মধ্যে একা বসে আছে। খোদেজার মা বারান্দা থেকে ডাকল–এই ছেড়া, খামাখা বৃষ্টিতে ভিজতাছস ক্যান? যা, মার হাত ধইরা মার মাথার কাছে বইস্যা থাক।
সুবল নড়ল না। ভিজতে থাকল।
ফজরের নামাজ শেষ করে ইরতাজুদ্দিন বাংলোঘরে এসে দেখেন মতি বসে আছে। উদভ্রান্তের মত চেহারা–বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ করছে। খালি পা, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। ইরতাজুদ্দিনের ভুরু কুঞ্চিত হল–খালি পায়ে যে আসছে সে বাংলোঘরে ঢুকবে কেন? সে দাঁড়িয়ে থাকবে উঠোনে।
মতি বলল—বিরাট বিপদে পড়ে আপনের কাছে আসছি স্যার।
ইরতাজুদ্দিনের ভুরু আরও কুঞ্চিত হল। কি বিপদ আঁচ করতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
বল কি ব্যাপার। পরাণ কাকার স্ত্রীর সন্তান হবে…
তাকে থামিয়ে দিয়ে ইরতাজুদ্দিন বললেন–সেটা তার বিপদ, তোমার কি? আমার কাছেই বা কেন?
আপনার বড় নাতনী ডাক্তার…
সে ডাক্তার ঠিকই আছে–সে তো আর পাই না যে বাড়ি বাগিয়ে বাচ্চা প্রসব করাবে।
চাচা, কাকী মারা যাইতাছে–একজন ডাক্তার দরকার।
শোন মতি, তোমাকে একটা কথা বলি–আমার নানা ডাক্তার ঠিকই আছে–শেষ মুহূর্তের একটা রোগি দেখবে, তারপর রোগি যাবে মরে–এটা কি ভাল? লোকজনের ধারণা হবে, আমরা নাতনী খারাপ ডাক্তার। এটা তো আমি হতে দেব না। কিছুতেই না। মেয়েটা এসেছে বেড়াতে, অসুখবিসুখ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার জন্য আসে নাই…।