ধ্যাৎ, তুই বানিয়ে বানিয়ে বলছিস।
বানিয়ে বানিয়ে বলব কেন, এটা হল আমলকি গাছ।
আর ঐ গাছগুলির নাম কি?
নীতু গম্ভীর গলায় বলল–ইপিল ইপিল।
যা মনে আসছে বলে ফেলছিস। ইপিল ইপিল গাছের নাম হয়?
হ্যাঁ হয়। তুমি যেমন অনেক কিছু জান যা আমি জানি না–আমিও তেমনি অনেক কিছু জানি যা তুমি জান না। যে কোন গাছের পাতা এনে দাও, আমি নাম বলে দেব।
শিখলি কোথায়?
আমি আর মিতু আপা প্রায়ই বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাই না? আমাদের কাজই তো হচ্ছে গাছের নাম মুখস্থ করা।
কেন?
এটা আমাদের একটা খেলা। আমি আর মিতু আপা দুজনে মিলে খেলি–তবে মিতু আপা আমার সঙ্গে পারে না।
শাহানা বলল, তুই সব গাছ চিনিস এটা যেমন বিশ্বাস করতে পারছি না আবার তেমনি অবিশ্বাসও করতে পারছি না–ঐ বড় বড় পাতাওয়ালা গাছটার কি নাম?
কাঠবাদাম।
আচ্ছা দাঁড়া, স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি। ঐ বুড়োকে জিজ্ঞেস করব?
কর।
বুড়ো মানুষটা শাহানাদের কেমন ভীত চোখে দেখছে। শাহনা ভেবে পেল না–তাদের দেখে ভয় পাবার কি আছে। সবাই তাদের ভয় পাচ্ছে কেন? শাহানা এগিয়ে গেল–হাসিমুখে বলল, আচ্ছা শুনুন, এই গাছটার নাম কি?
আম্মা, এইটা হইল কাঠবাদাম গাছ। সাদা সাদা ফুল হয়। বড় সৌন্দর্য।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি কি গায়ক মতির বাড়িটা চেনেন?
আমরার মতি মিয়া?
হ্যাঁ, আপনাদের মতি মিয়া।
আইয়েন লইয়া যাই।
নিয়ে যেতে হবে না। আমাদের বলে দিন–আমরা যেতে পারব।
বুড়ো মানুষটা তারপরেও সঙ্গে গেল। বাড়ির সামনে তাদের দাঁড়া করিয়ে তারপর গেল। এই কাজটি করতে মানুষটাকে খুব আনন্দিত মনে হল।
মতি ভাত চড়িয়েছে। উঠানের চুলায় রান্না হচ্ছে। চুলা ভেজা, প্রচুর ধোয়া হচ্ছে। আগুন বার বার নিভে যাচ্ছে। রান্না সামান্য–ভাত, ভাতের হাড়িতেই দুটা আলু সেদ্ধ করতে দেয়া হয়েছে। ভাত–আলুভর্তা। সঙ্গে ডাল থাকলে জমিয়ে খাওয়া হত। ডাল ঘরে নেই। মতি চুলার পাশে বসে উঁচু মার্গের চিন্তা-ভাবনা করছে।
খিদে নামক একটা জটিল ব্যাপার দিয়ে আল্লাহপাক মানুষকে যে বিপদে ফেলেছেন এই নিয়েই সে এখন ভাবছে। খিদে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানে পরাধীন হয়ে জন্মানো। খিদে না থাকলে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে মানুষ জন্মাত। আল্লাহপাকের মানুষকে পুরোপুরি স্বাধীন করার ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা থাকলে তিনি অবশ্যই একটা উপায় করতেন।
পায়ের শব্দে মতি পেছনে ফিরে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। শাহানা হাসিমুখে বলল, কি করছেন?
মতি জবাব দিতে পারল না। তার উঠে দাঁড়ানো উচিত, সে দাঁড়াতে ভুলে গেছে। শাহানা বলল, হুট করে আপনার বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছি। রাগ করেননি তো? অবশ্যি হুট করে ঢুকে পড়া ছাড়া উপায়ও নেই। গ্রামে তো আর কলিংবেল নেই যে প্রথমে বেল বাজাব।
মতি উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই-বা সে কি করবে? এদের কোথায় বসতে দেবে? ঘরে কোন চেয়ার নেই। উঠানের এক মাথায় একটা জলচৌকি পড়ে আছে। বৃষ্টির কাদায় সেটা মাখামাখি।
শাহানা বলল, আপনি আমাদের জন্যে ব্যস্ত হবেন না, বিব্রতও হবেন না। আমরা চলে যাব। আপনি বলেছিলেন গান শুনাবেন। তারপর তো আর আপনার কোন খোঁজ নেই। গানের ব্যবস্থা হচ্ছে?
জ্বি জ্বি।
ও আচ্ছা। আমি ভাবলাম বোধ হয় ভুলে গেছেন।
জ্বি না, ভুলি নাই। আমার ইয়াদ আছে।
আমরা তাহলে যাই, আপনি রান্না করুন।
মতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। জটিলতার উপর জটিলতা–সে আছে খালি গায়ে। নীতু বলল, আপনি কি রাঁধছেন?
ভাত।
ভাত তো না। চাল রাঁধছেন। চাল ফুটে ভাত হবে। ভাতের সঙ্গে তরকারি কি?
আলু সিদ্ধ দিছি।
আলুসিদ্ধ আর ভাত? দুটাই তো কার্বোহাইড্রেট–প্রোটিন কোথায়? মানুষের শরীরে প্রোটিন দরকার। তাই না আপা?
মতি ক্ষীণ স্বরে বলল, মানুষের তো অনেক কিছুই দরকার। সব তো আর হয় না।
শাহানা বলল, আমরা যাচ্ছি, আপনি রান্না করুন। রান্নার মাঝখানে বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।
শাহানা নীতুকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মতি আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। তার উচিত ছিল এগিয়ে দেয়া, তাও সে করল না। চূলা নিভে প্রচুর ধোঁয়া উঠছে। ধোঁয়ায় মতির চোখ জ্বালা করছে।
পরাণ ঢুলীর বাড়িতে
পরাণ ঢুলীর বাড়িতে মতি বসে আছে। অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা ঠিকঠাক করা দরকার। একটু বাদ্য-বাজনাও হোক। মন উদাস লাগছে–বাদ্য-বাজনায় উদাস ভাবটা হয় কাটবে নয় আরও বাড়বে। দুটাই ভাল। উদাস হলে পুরোপুরি উদাস হওয়া দরকার।
সাধারণত এই আসর বাড়ির দাওয়ায় মাদুরের উপর বসে। আজ বসেছে একটু দূরে, ছাতিম গাছের নিচে। পরাণের চোখে-মুখে রাজ্যের অনাগ্রহ। তার মন ভাল নেই, শরীরও ভাল নেই। সারা সকাল পেটের ব্যথায় ছটফট করেছে। দুপুরের পর ব্যথা কমেছে তবে শরীর ঝিম ধরে আছে। বিকালে শুরু হয়েছে তান্য যন্ত্রণা—তার স্ত্রী দুর্গার প্রসবব্যথা উঠেছে। এটা তেমন কিছু না–স্ত্রীলোক, বছরে–দুবছরে প্রসবব্যথা হবেই। প্রথমে খানিকটা দুশ্চিন্তা থাকে–তারপর দুশ্চিন্তার কিছু থাকে না। দূর্গার এই নিয়ে সপ্তমবার। সন্তান প্রসব তার কাছে ডালভাতের মত হয়ে যাবার কথা। হয়েছেও তাই–এই অবস্থাতেও সে সংসারের টুকটাক কাজ সারছে। রাতের ভাত আগেভাগে বেঁধে ফেলেছে। মাষকলাইয়ের ডাল রান্না করা আছে। রাতে আর কিছু না রাধলেও হবে। ধাইকে খবর দেওয়ার জন্যে ছোট ছেলেটাকে পাঠিয়েছে। এই ছেলেটা খুব কাজের। সে যে শুধু খবর দেবে তাই না–যত রাতই হোক সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।