মনোয়ারার পিঠে রোদ এসে পড়েছে। রোদে গা জ্বলছে, কিন্তু জলচৌকি ছেড়ে উঠতে পর্যন্ত ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে তার গায়ে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটাও এখন আর নেই। মানুষটা কোন খবর পর্যন্ত দেবে না–এটা কেমন কথা? তিনি কুসুমকে পাঠিয়েছিলেন সেলিম বেপারীর কাছে। সে দেশে-বিদেশে ঘুরে–কুসুমের বাবার কোন খবর যদি পায়! কুসুম এখনো ফিরছে না। মনোয়ারার মন বলছে, কুসুম কোন একটা ভাল খবর নিয়ে আসবে। তিনি ঠিক করলেন, কুসুম না ফেরা পর্যন্ত তিনি রোদ থেকে উঠবেন না।
কুসুম ফিরেছে। মনোয়ারা অবাক হয়ে দেখলেন কুসুমের হাতে একটা ঝাটা। সে কি ঝটা হাতে বেপারীর বাড়ি গিয়েছিল? তার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল, মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কুসুম, তুই বেপারী বাড়ি যাস নাই?
না।
কই গেছিলি?
মতি ভাইরে দেখতে গেছিলাম।
কি জন্যে?
জ্বরে মানুষটা মইরা যাইতেছে, একটা চউখের দেখা দেখব না? এটা তুমি কেমন কথা কও মা?
তোর বাপের যে কোন খোঁজ নাই এইটা নিয়া তোর কোন মাথাব্যথা নাই। তুই কেমন মেয়ে রে কুসুম?
খারাপ মেয়ে।
মতিরে দেখতে গেলি ঝাড়ু হাতে?
হুঁ। উল্টা-পাল্টা কিছু কইলে ঝাড়ু দিয়া মাইর দিমু–এই ভাইব্যা ঝাড়ু নিয়া গেছি।
মনোয়ারা চুপ করে গেলেন। মেয়ের লক্ষণ ভাল বোধ হচ্ছে না। জ্বীনের আছর হচ্ছে কিনা কে জানে। মানোয়ারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, কুসুম আবার বেরুচ্ছে। মনোয়ার গলার স্বর কোমল করে বললেন, কই যাস কুসুম?
বেপারী বাড়িত যাই। বাপজানের খোঁজ লইয়া আসি।
থাউক, বাদ দে।
কুসুম থামল না, হন হন করে বের হয়ে গেল। সে ঠিক করেছে বেপারী বাড়ি সে যাবে ঠিকই তবে যাবার আগে মতি ভাইয়ের বাড়ি হয়ে যাবে। হাসিমুখে দুটা কথা বলে যাবে।
কুসুম মতিকে পেল না। মতি জ্বর গায়েই নিন্দালিশ চলে গেছে। আবদুল করিমের সঙ্গে কথা বলবে। তার মন বলছে আবদুল করিম বায়না ছাড়াই আসতে রাজি হবে।
আবদুল করিম খুব মন দিয়ে মতির কথা শুনল। মাঝখানে একবার শুধু বলল, আপনের গলাত কি হইছে, শব্দ বাইর হয় না? মতি বলেছে, ঠাণ্ডা।
ও আচ্ছা, বলেন কি বলতেছেন।
মতি যথাসম্ভব গুছিয়ে তার বক্তব্য বলল। গানের আসর সে করছে। ঢাকা শহরের বিশিষ্ট কিছু মানুষ গান শুনবে। সে যে গানের দল করেছে তার নাম ফাটবে। এই দলে আবদুল করিমের মত প্রতিভ না থাকলে কিভাবে হয়?
আবদুল করিম বলল, গানের দলের কথা বাদ দেন। আসর হইতেছে তাঁর বিষয়ে বলেন। বায়না কত?
বায়না-টায়না নাই। খুশি হইয়া তারা যা দিব সবই আফনের। কথা দিলাম।
তারা খুশি হইব এইটা বলছে কে?
ভাল জিনিশে খুশি হয় না এমন মানুষ খোদার আলমে আছে?
গান-বাজনা ভাল জিনিশ আফনেরে বলছে কেংগেনবাজনা হইল শয়তানী বিদ্যা।
আইচ্ছা, সেটা যাই হোক–আফনের যাওন লাগব।
আবদুল করিম উদাস গলায় বলল, মতি মিয়া–
মাগনার কাম জলে যায়
পুটি মাছে গিল্যা খায়।
আফনে বাড়িত যান–আমার বেহালার তার ছিঁড়া।
মতি আরও কি বলতে যাচ্ছিল। আবদুল করিম তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। তবে অনাদর করল না। দুপুরে যত্ন করে ভাত খাওয়াল। তার ছোট মেয়ে ভাত তরকারি এগিয়ে দিচ্ছিল, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল–ভাল কইরা যত্ন করবে ফুলি–ইনি মতি মিয়া। বয়স অল্প। অল্প হইলে কি হইব–গলা মারাত্মক। গানের দল করছে। যে-সে মানুষ না, দলের অধিকারী।
মতি ফুলির দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। ফুলি বলল, অধিকারী সাব, আমরারে গান শুনাইবেন না?
মতির জবাব দেবার আগেই আবদুল করিম প্রচণ্ড ধমক লাগাল–সম্মান রাইখ্যা কত বল ফুলি। আদবের সঙ্গে কথা বল। মুখের কথা বলতেই গানে টান দিব? বেয়াদব। গান অত সস্তা?
মতি অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ছোট মানুষ।
ছোট মানুষ বড় মানুষ কিছু না। আদবের বরখেলাপ আমার না-পছন্দ। গানবাজনার বিদ্যা অতি কঠিন বিদ্যা। এর অসম্মান দেখলে আমার মাথাত আগুন জ্বলে।
আবদুল করিমের বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন অতি সাধারণ। কিন্তু বড় যত্ন করে খাওয়াল ফুলি। পর্দার আড়ালে থেকে সব লক্ষ্য করলেন ফুলির মা।
দুপুরে খাওয়ার পরপরই রওনা হওয়া গেল না। আবদুল করিম বিছানা করে দিয়েছে। পান-তামাকের ব্যবস্থা করেছে।
পান-তামুক খাইয়া শুইয়া জিরান। শইলের যত্ন করেন। গান বাজনা পরিশ্রমের ব্যাপার। পরিশ্রমের জন্যে শইল ঠিক রাখতে হয়। ঐ ফুলি, হাতপাখা লইয়া আয়। চাচারে বাতাস কর।
না না, বাতাস লাগব না। বাতাস লাগব না।
আফনে আমরার বাড়ির মেহমান। কি লাগব না লাগব সেইটা আমি বিবেচনা করব।
আবদুল করিমকে আনতে না পারার দুঃখ মনে পুষে মতিকে ফিরতে হল। কোন রকমে শখানেক টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে–একটা আসরে বসা যেত। কোথায় পাওয়া যায় শখানেক টাকা…!
শহরের বাড়িগুলির সুন্দর সুন্দর নাম থাকে
শহরের বাড়িগুলির সুন্দর সুন্দর নাম থাকে–দাদাজানের বাড়িটার কোন নাম নেই। একটা নাম থাকলে সুন্দর হত। শাহানা নীতুকে নিয়ে হাঁটছে আর মনে মনে এই প্রকাণ্ড বাড়িটার একটা নাম ভাবছে। কোন নামই পছন্দ হচ্ছে না–নিদমহল, সুখানপুকুর প্যালেস, কুঠিবাড়ি… ইরতাজুদ্দিন সাহেব নাতনীদের একা একা দেয়ালের বাইরে যাবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তারা এখন একা নয়, দুজন। কাজেই দেয়ালের বাইরে যেতে পারে। শাহানা ঠিক করেছে আজ সে দ্বীপের মত এই গ্রামটা পুরো চক্কর দেবে। তার সঙ্গে একটা খাতা ও কলম আছে। গাছের নাম লিখবে। গেটের কাছে এসে নীতু থমকে দাঁড়াল। সরু গলার বলল, কোথায় যাচ্ছ আপা?