খুবই মোটা ইংগিত। এই ইংগিত যে বুঝতে পারবে না সে মানুষ না–খাটাশ। মতি বোধহয় পারবে না। জগতে অনেক বুদ্ধিমান মানুষ আছে যারা প্রয়োজনের সময় খাটাশের মত হয়ে যায়। সে নিজে যেমন হয়েছে। কি কথা বলতে এসে কি বলছে।
মতি বলল, উঠান ঝাট দেওনের দরকার নাই কুসুম।
দরকার নাই ক্যান? বাড়ি পতিত ফেলাইবেন?
মতি কিছু বলল না। অকারণে খানিকক্ষণ কাশল।
কুসুম বলল, জ্বর কমছে?
হ্যাঁ।
জ্বর কমছে তয় খেতা শইল্যে দিয়া আছেন ক্যান?
মতি জবাব দিল না। কুসুম বলল, কথা কন না ক্যান? জ্বরে জিবরা মোটা হয় গেছে? না কথা বলা বিস্মরণ হইছেন?
তুমি রাগারাগি করতেছ কেন কুসুম? মিষ্টি গলায় কথা বলা তুমি জান না?
আফনের সঙ্গে আমি মিষ্টি গলায় কথা বলব ক্যান? আফনে আমার কে? আফশে কি আমার পারতের লোক?
মতির মন খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটা অকারণে তার সঙ্গে ঝগড়া করে। এত সুন্দর একটা মেয়ে, অথচ কি বিশ্রি স্বভাব! শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা খুব কষ্টে পড়বে।
জ্বর হইছে, ভিতরে গিয়া শুইয়া থাকেন। হা কইরা খাড়াইয়া আছেন ক্যান?
মতি ঘরে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কুসুমের চোখে পানি এসে গেল। এটা সে কি করেছে? সে হাতের ঝাঁটা ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এখন সে কি করবে? চোখের পানি মুছে মতির ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে সে কি বলবে–মতি ভাই, আফনেরে খুব একটা শরমের কথা বলতে আসছি। কথাটা হইল…
না, কথাটা আজ বলা যাবে না। কথাটা বলতে গেলেই সে কেঁদে-কেটে একটা কাণ্ড করবে। সে সবাইকে তার চোখের পানি দেখাতে রাজি আছে, শুধু একজনকে না। মতি আবার বের হয়ে এসেছে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মতি বলল, কি হইছে কুসুম?
কই কি হইছে?
কানতেছ কেন?
আমার পেটে হঠাৎ হঠাৎ একটা বেদনা হয়। তখন কান্দি।
কও কি? অসুখ হইছে, চিকিৎসা করবা না?
কুসুম চোখ মুছতে মুছতে বলল, গরীবের এক অসুখ, তার আবার এক চিকিৎসা। গরীবের চিকিৎসা হইল কাফনের কাপড় দিয়া শইল ঢাকা।
অসুখের কোন গরীব-ধনী নাই কুসুম। অসুখ সবের জন্যেই সমান। চান্দের। আলো যেমন গরীব-ধনী সবের জন্যেই এক, অসুখ-বিসুখও…
চুপ করেন মতি ভাই। জ্ঞানের কথা কইয়েন না। চান্দের আলো আর পেটের বেদনা দুইটা এক হইল?
মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আসল কথা এইটা না কুসুম। আসল কথা হইল–কিছু কিছু সময় আছে যখন গরীব-ধনী এক হইয়া যায়–যেমন ধর, তুমি আর ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বড় নাতনী। তোমরার দুইজনেরই হইল কলেরা। তখন কিন্তু দুইজনেই এক হইয়া গেলা।
না, এক হব কেমনে? উনার চিকিৎসা হবে। দুনিয়ার বেবাক ডাক্তার ছুইটা আসবে। অষুধ, পথ্য, সেবা। আর আমারে ফালাইয়া থুইবে উঠানে।
তোমার এই পেটের বেদনা কি অনেক দিন ধইরা চলতেছে?
হাঁ।
খুব বেশি?
মাঝে মাঝে খুব বেশি। তখন ইচ্ছা করে কেরোসিন কিন্যা শাড়িত ঢাইল্যা আগুন দিয়া দি। তখন ঘরে কেরোসিন থাকে না বইল্যা আগুন দিতে পারি না। মাঝে মইধ্যে পানিতে ঝাঁপ দিয়া পড়তে ইচ্ছা করে। পানিতে ঝাঁপ দেই না–পানিতে ঝাঁপ দিলে মরণ হইব না–সাঁতার জানি।
মতি বলল, ইরতাজুদ্দিন সাবের বড় নাতনী যে আছে–ইনারে তুমি একবার দেখাও। খুবই বড় ডাক্তার। ইরতাজুদ্দিন সাব বলছেন উনি ডাক্তারি স্কুল থাইক্যা সোনার একটা মেডেল পাইছে।
কথায় কথায় ইরতাজুদ্দিন সাবের নাতনী, ইরতাজুদ্দিন সাবের নাতনী বলতেছেন ক্যান? মেয়েটা খুব সুন্দর?
মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, খুবই সুন্দর। চেহারা যেমন সুন্দর ব্যবহারও সুন্দর। অতি মধুর ব্যবহার। অত বড়ঘরের মেয়ে ব্যবহারে বুঝনের কোন উপায় নাই। মনে হইব নিজেরার মানুষ। আমার কথা বিশ্বাস না হইলে একদিন নিজে গিয়া আলাপ কর–দেখবা কত খাঁটি কথা বলছি।
কুসুম তাকিয়ে আছে। গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে সে মতির উত্তেজনা দেখছে।
বুঝলা কুসুম–ইনারে গান শুনাইতে হবে। গানের একটা আসর করব। ভাবতেছি নিন্দালাইশের আবদুল করিম ভাইরে খবর দিয়া আনব। আমি, করিম ভাই, আমরার পরাণ কাকা–আরেকবার যদি পাইতাম ব্যাঞ্জো বাজানীর কেউ…
ব্যাঞ্জো বাজানীর লোক নাই?
উহুঁ।
তাইলে তো আফনের বেজায় বিপদ।
করিম ভাই আইলে অবশ্য বিপদ কাটা যায়। একশ টেকার কমে উনি আসব। আমার কাছে আছে মোটে পঞ্চাশ…
উনার কাছে গিয়া চান।
কার কাছে চাব? ইরতাজুদ্দিন সাবের নাতনীর কাছে? ছিঃ ছিঃ! কি বল তুমি!
কুসুম বলল–অখন যাই। বেলা হইছে। মতি বলল, আমি কি উনারে বলব তোমার চিকিৎসার কথা?
কুসুম কঠিন গলায় বলল, আগবাড়াইয়া মাতাব্বরি কইরেন না। আফনের কিছু বলনের দরকার নাই।
হঠাৎ রাইগা গেলা কেন?
কুসুম জবাব দিচ্ছে না–হন হন করে এগুচ্ছে। মতি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।
মনোয়ারা তাঁর বাড়ির উঠোনের জলচৌকিতে বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার শরীর এবং মন দুটাই খুব খারাপ। শরীর দীর্ঘদিন থেকেই খারাপ, এটা এখন আর। ধর্তব্যের মধ্যে না। মন খারাপটাই এখন প্রধান। মুম খারাপের কারণ–কুসুমের। বাবার কোন খোঁজ-খরব পাওয়া যাচ্ছে না। এক মাসের উপর হয়ে গেল। এর মধ্যে কোন সংবাদ নেই, চিঠিপত্র নেই। নৌকা নিয়ে এর আগেও সে বের হয়েছে। একবার তো তিনমাস পার করে ফিরেছে। কিন্তু খর পাঠিয়েছে। টাকাপয়সা পাঠিয়েছে। এবার কোন সাড়াশব্দই নেই।
রোজ রাতে শোবার সময় মনোয়ারার মনে হয়–মাঝরাতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কুসুমের বাবা বলবে–বৌ, উঠ দেখি। দরজা খুলে দেখা যাবে জিনিশপত্র নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। এই এক স্বভাব মানুষটার। খালি হাতে কখনো আসবে না। টাকাপয়সা যা কামাবে, বলতে গেলে তার সবই খরচ করে আসবে। হাতের চুড়ি, আলতা, গন্ধ তেল, সাবান। এই সব জিনিশের চেয়ে নগদ টাকা অনেক বেশি দরকার। লোকটা তা বুঝে না। মনোয়ারাও কিছু বলেন না। শখ করে এনেছে, আনুক। রোজগারী মানুষের শখের একটা দাম আছে না? তাছাড়া মেয়ে দুটি জিনিশ পেয়ে বড় খুশি হয়। কুসুম এত বড় ধামড়ি এক মেয়ে, সেও আলতা-সাবান চিরুনী হাতে নিয়ে লাফ ঝুঁফ দিতে থাকে। মনোয়ারা ধমক দেন–ঐ কুসুম, করস কি তুই? বাপের সামনে বেহায়ার মত লাফ দিতাছস। মোবারক তখন মৃদু গলায় বলে–সব জিনিস দেখন নাই বৌ। দুই-একটা লাফ দিলে কিছু হয় না। মনোয়ারার ধারণা, কুসুমের বাবা মেয়ে দুটির লাফালাফি ঝাপাঝাপি দেখার জন্যেই আজেবাজে জিনিশ কিনে পয়সা নষ্ট করে।