নীতু ধাঁধায় পড়ে গেল। তার ভয় ভয়ও করতে লাগল। পুষ্প গলার স্বর নামিয়ে বলল–গেরামদেশ হইল বুবু জ্বীন-ভূতের দেশ। আমার মাইঝলা ভইনরে ক্যাসুনে পানিত ড়িবাইয়া মারছে এইটা শুনেন… জ্বীনে ধরল… মাঘ মাসের শীত। জব্বর শীত পড়ছে…
নীতু বলল, জ্বীন-ভূতের গল্প আর শুনব না।
শাহানা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে। শহরে অন্ধকার দেখার সুযোগ নেই। এখন আবার পথে পথে সোডিয়াম ল্যাম্প। রাত হলেই মনে হয় শহরটার জণ্ডিস হয়েছে। অন্ধকারও যে দেখতে ভাল লাগে তা এখানে এসেই শাহানা বুঝতে পারছে। দেখতে ভাল লাগার প্রধান কারণ বোধহয় গ্রাম কখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। ঐ তো জোনাকি পোকা জ্বেলছে, নিভছে। কি অদ্ভুত সুন্দর। জোনাকি পোকারা শহর পছন্দ করে না, কারণটা কি–শহরে প্রচুর আলো এই জন্যে? এরা শুধু অন্ধকার খুঁজে বেড়ায়।
একা একা এখানে কি করছিস?
জোনাকি পোকা দেখছি। আপনি কোথায় ছিলেন?
এশার নামাজ পড়লাম–তুই কি নামাজ টামাজ পরিস, না তোর বাবার মত হয়েছিস?
শাহানা হাসতে হাসতে বলল, বাবার মত হয়েছি।
তোদের বাসায় কেউ নামাজ পড়ে না?
মা খুব পড়ে। তাহাজুদও পড়ে। এখন এক পীর সাহেবের মুরিদ হয়েছে। বাবা মাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করেন।
ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন–হাসাহাসি করার কি আছে?
পীর সাহেব-টাহেব নিয়ে মার মাতামাতি দেখে হাসাহাসি করেন। ধর্ম বিষয়ে মজার মজার তর্ক তুলে মাকে রাগিয়ে দেন। রেগে গেলে মা একেবারে নীতুর মত–কেঁদে কেটে একাকার।
ইরতাজুদ্দিন আরো গম্ভীর হয়ে বললেন–ধর্ম বিষয়ে মজার তর্ক কি?
শাহানা হাসল। অন্ধকারে ইরতাজুদ্দিন তার হাসি দেখলেন না। শাহানা বলল–বাবা বলেন, আমাদের আল্লাহর অংক জ্ঞান তেমন সুবিধার ছিল না–অংকে তিনি সামান্য কাঁচা। সম্পত্তি ভাগের যে আইন কোরান শরীফে আছে সেখানে ভুল আছে। যে ভুল হযরত আলী পরে ঠিক করেছিলেন, যাকে বলে আউল।
ইরতাজুদ্দিন রাগী গলায় বললেন–ফারায়েজী আইনে ভুল, এইসব তুই কি বলছিস?
আমি কিছু বলছি না, বাবা বলছেন। ভুলটা কেমন আপনাকে বলি দাদাজান। যেমন ধরুন, এক লোকের বাবা আছে, মা আছে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী আছে সে মারা গেল। ফারায়েজী আইনে তার সম্পত্তি কি ভাবে ভাগ হবে? মা পাবে ১/৬, বাবা ১/৬, দুই মেয়ে ২/৩, স্ত্রী ১/৮, এদের যোগ করলে হয় ২৭/২৪, তা তো হতে পারে না।
তোর বাবা এখন কি এইসবই করে বেড়ায়? ভুল-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়? সে নিজেকে কি মনে করে–দি পারফেক্ট?
আপনি ব্যাপারটাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছেন দাদাজান।
আমি অন্যদিকে নিচ্ছি না। আমি শুধু তোর বাবার স্পর্ধা ও সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। সে আমারও ভুল ধরে। তার কত বড় সাহস, সে আমাকে চিঠি লিখে–আপনি যে অন্যায় করেছেন তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত…। আমি তার জন্মদাতা পিতা, সে আমার ভুল ধরে আমাকে শাস্তি দিতে চায়…
ইরতাজুদ্দিন রাগে থর থর করে কাপছেন। শাহানা দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। জোনাকি পোকা এখনো জ্বলছে, নিড়ছে, কিন্তু তার আলো এখন আর দেখতে ভাল লাগছে না।
মতির জ্বর পুরোপুরি সারেনি
মতির জ্বর পুরোপুরি সারেনি। এম্নিতে ভাল, একটু হাঁটাহাঁটি করলেই মাথা ঘুরতে থাকে, গা গরম মনে হয়। সবচে বড় সমস্যা হল গলা বসে গেছে। গলা দিয়ে হাসের মত ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ বের হচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের নাতনীকে গান শুনাবার কথা ছিল। গলা না সারলে কিছু করার নেই। পরাণ ঢুলীর ঢোলটা আগেভাগে শুনিয়ে দেয়া যায়। শুধু ঢোল ভাল লাগবে না, ঢোলের সঙ্গে সঙ্গত করার কোন কিছু নেই। বেহালা সে বাজাতে পারে। পরাণের সঙ্গে বাজানো সম্ভব না–তার হচ্ছে জোড়াতালির ব্যাপার। নিদালাইশের আবদুল করিমকে নিয়ে এলে সব সমস্যার সমাধান হয়। জ্বর-শরীরে যাবে কি ভাবে? তাও না হয় গেল–আবদুল করিমের টাকাপয়সার খুব খাই। আগে টাকা তারপর কথা। মাগনার কারবার নাই। অনুরোধ উপরোধ যাই করা হোক–আবদুল করিম বলবে–
মাগনার কাম জলে যায়
পুটি মাছে গিল্যা খায়।
মাফ কইরা দিয়েন। বেহালার তার ছিঁড়া, জোড়া দেওনের ব্যবস্থা নাই।
একশ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিলে অবশ্যি ছেঁড়া তার সাথে সাথে জোড়া লেগে যায়। সেই টাকা জোগাড় করাই সমস্যা। কোথায় সে পাবে একশ টাকা?
তার নিজের হাত একেবারে খালি। ইরতাজুদ্দিন সাহেব তাঁর নাতনীকে নিয়ে আসার জন্যে তাকে খরচা বাবদ পঞ্চাশটা টাকা পাঠিয়েছেন। সম্বল বলতে এই। টাকাটা নিতে মতির খুবই লজ্জা লেগেছে। না নিয়েও পারেনি। গান বাজনা বাবদ সে তো আর আগেভাগে টাকা চাইতে পারে না।
মতি নিন্দালাইশে যাওয়াই ঠিক করল। আবদুল করিমের দুপা জড়িয়ে ধরলে। যদি কিছু হয়। সম্ভাবনা নেই বললেই হয়, তারপরেও… কিছুই তো বলা যায় না। জগৎ চলে আল্লাহপাকের ইশারায়। আল্লাহপাক যদি ইশারা দিয়ে দেন আবদুল করিম চলে আসবে। তার গানের দলেও যোগ দিতে পারে। আবদুল করিমকে পাওয়া গেলে শক্ত একটা দল হয়।
উঠানে ঝাঁট দেয়ার শব্দ। কে ঝাঁট দেয়? মতি চাদর গায়ে বইরে এসে দেখে কুসুম। গাছ কাপড়ে শাড়ি পরে প্রবল বেগে উঠান ঝাঁট দিচ্ছে। মতি বিস্মিত হয়ে বলল, কর কি?
কুসুম বলল, কি করি দেখেন না? চউখ নাই–কানা?
বলেই কুসুমের মন খারাপ হয়ে গেল। কি বিশ্রি করেই না সে কথাগুলি বলল! অথচ আজ সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, যেভাবেই হোক একটা কাজ সে আজই করবে। সারা পৃথিবীর মানুষ তাকে বেহায়া বললেও করবে। তার গায়ে থুথু দিলেও করবে। কাজটা হচ্ছে–সে মতির কাছে গিয়ে বলবে–এই যে অধিকারী সাব! আফনে গানের দল করছেন। দল নিয়া দেশে-বৈদেশে ঘুরবেন। আমি ঠিক করছি, আমিও আফনের দলের লগে যামু। দেশ-বৈদেশ ঘুরমু। আফনেরার রান্ধনেরও তো লোক দরকার। দরকার না?