নীতু নিতান্ত অনিচ্ছায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার কাছে মোটেই সুন্দর লাগছে না, বরং ভয় আরও বেশি লাগছে। ঘন কালো আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের ঝাপ্টা চোখে-মুখে লাগছে। নীতু ফিস ফিস করে বলল, পেতলের বদনায় ছেলেটাকে কি খাওয়াচ্ছে জান আপা?
না।
তালতলার পীর সাহেবের পড়া পানি। এই পড়া পানি পেতলের পাত্রে রাখতে হয়। না রাখলে পানির গুণ নষ্ট হয়ে যায় ছেলেটার কামেলা রোগ হয়েছে। কামেলা রোগ কি আপা?
কামেলা হল জণ্ডিস।
পড়া পানি পেতলের পাত্রে রাখলে গুণ নষ্ট হয় না কেন আপা?
আমি জানি না। তালতলার পীর সাহেব হয়ত জানেন।
আপা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে…।
হুঁ। প্রচণ্ড ঝড় হবে, তাই না আপা?
ঝড় হবে কি-না বুঝতে পারছি না, তবে বৃষ্টি হবে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে ঝড় হবে। আচ্ছা আপা, ঝড়ের সময় ট্রেন কি চলতে থাকে, না এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে?
জানি না।
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
ট্রেন থেকে আমরা যখন নামব তখন ট্রেনের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস। তারই জানার কথা। জিজ্ঞেস করবি?
তুমি আমার হয়ে জিজ্ঞেস করে দেবে?
আমি করব না। তুই করবি। তোর কৌতূহল হয়েছে, তুই মেটাবি।
তোমার কোন কৌতূহল নেই?
শাহানা সহজ গলায় বলল, ঝড়ের সময় ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে, না চলতে থাকে। এটা জানার কোন কৌতূহল নেই। পৃথিবীতে জানার অনেক বিষয় আছে।
ট্রেনের কামরায় হারিকেন জ্বলছে। অসুস্থ ছেলেটির বাবা হারিকেন ধরিয়েছে। এরা রাতে ট্রেনে চাপলে হারিকেন সঙ্গে নিয়েই উঠে। হারিকেনটার কাচ ভাঙা। লাল শিখা দপদপ করছে। যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। নীতু গভীর আগ্রহ নিয়ে হারিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে পেনসিল টর্চ। টচটা কিচ্ছ করছে না। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। হালকা বর্ষণ। শাহানা মাথা বের করে ভিজছে।
ঠাকরোকোনা স্টেশন আসতে দেরি নেই। সামনের স্টেশনই ঠাকরোকোনা। ট্রেনের গতি এখনো কমতে শুরু করেনি। আউট স্টেশনের সিগন্যালের পর কমতে থাকবে। শাহানা হাতের ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল। রেডিয়াম ডায়ায় থাকা সত্ত্বেও ঘড়ির লেখা পড়া যাচ্ছে না। তবে রাত নটার মত বাজে। চর ঘণ্টা লেট। রাত নটা ঢাকা শহরে এমন কিছু রাত না–কিন্তু ঢাকার বাইরে গভীর রাত। শাহানা চিন্তিত বোধ করছে। এতক্ষণ সে সাহসী তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে–ট্রেন থামার পর সত্যিকার অর্থেই সাহসী তরুণী হতে হবে। সুখানপুকুরে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে–দুটি মেয়ে ইচ্ছা করলে নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াতে পারে। বডিগার্ডের মত একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে না থাকলেও হয়।
ভরা বৃষ্টির মধ্যে তারা স্টেশনে নামল। তাদের নামিয়ে দিয়েই ট্রেন হুস করে চলে গেল। নীতু বলল, আপা, আমরা দুজনই শুধু নেমেছি–আর কেউ না। এটা স্টেশন তো? নাকি পথে কোথাও নেমে পড়েছি?
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে বাতির আভাস দেখা যায়। ঐটাই কি স্টেশন মাস্টারের ঘর? শাহানা আলোর দিকে এগুচ্ছে, নীতু আসছে তার পেছনে পেছনে। দুজনের হাতে দুটা স্যুটকেস। নীতু রাজ্যের গল্পের বই তার স্যুটকেসে ভরেছে বলে অসম্ভব ভারী। তার রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। কষ্টের সঙ্গে আতংকও যুক্ত হয়েছে–তার এখনো ধারণা তারা স্টেশনে নামেনি। কোন কারণে ট্রেন স্টেশনের আগেই থেমেছিল। তারা নেমে পড়েছে। নয়তো একটা স্টেশনে মাত্র দুজন যাত্রী নামবে কেন?
আপা!
হুঁ।
ভিজে গেছি তো আপা।
বৃষ্টির ভেতর হাঁটলে তো ভিজতে হবেই। তুই ভরা বৃষ্টিতে হাঁটবি আর গা থাকবে শুকনা খটখটে তা হয় না।
আমরা এখন কি করব?
প্রথমেই স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলব…।
তারপর?
তারপরেরটা তারপর।
নীতু আতংকিত গলায় বলল, আপা, আমি গোবরে পা দিয়ে ফেলেছি।
ভাল করেছিস।
শাহানা হাসছে। নীতুর প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে লক্ষ্য করছে, আজেবাজে ধরনের দুর্ঘটনা সব সময় তার কপালেই ঘটে। গোবরে শাহানার পাও পড়তে পারত। তা না পড়ে তার পা পড়ল কেন? সে কি দোষ করেছে?
ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে স্টেশন মাস্টার মনসুর আলি তাকিয়ে আছেন। তাঁর শরীর ভাল না। জ্বরে কাহিল হয়ে আছেন। এতক্ষণ চেয়ারে বসেই ঘুমুচ্ছিলেন। ট্রেন আসার শব্দে জেগে উঠেছেন। তাঁর চোখ-মুখ ভাবলেশহীন হলেও তিনি যে আকাশ থেকে পড়ছেন তা বোঝা যাচ্ছে। রাত-দুপুরে ফুটফুটে দুটি মেয়ে স্টেশনের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, এর মানে কি? একজনের বয়স বার-তের। অন্যজনের বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উনিশ কুড়ি হতে পারে আবার চব্বিশ-পঁচিশও হতে পারে। দুটি মেয়েই পরীর মত। সঙ্গে কোন পুরুষমানুষ দেখা যাচ্ছে না। এরা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেনি তো? বাড়ি থেকে পালিয়ে এলে পুলিশে খবর দিতে হয়। বাড়তি ঝামেলা। ঝড় বৃষ্টির রাত–কোথায় বাড়িতে গিয়ে আরাম করে ঘুমুবেন তা না, থানা পুলিশ ছুটাছুটি কর।
নীতু স্টেশন মাস্টারের দিকে অকিয়ে বলল, আপনাদের স্টেশনে টিউবওয়েল আছে? আমি পা ধোব। ভুলে আমি গোবরে পা দিয়ে ফেলেছি। স্টেশন ভর্তি এত গোবর কেন?
স্টেশন মাস্টার মনসুর আলির গলার স্বর এম্নিতেই ভাঙা। সেই স্বর আরো ভেঙে গেল। তিনি গোবর সমস্যার ধার দিয়ে গেলেন না। আগে মূল সমস্যাটা ধরতে হবে। তারপর গোবর। তিনি নীতুকে এড়িয়ে শাহানার দিকে তাকিয়ে বললেন–কোথায় যাওয়া হবে?