পুষ্প শুরুতে খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। এখন তার ভয় কেটে গেছে। সে নীতুর সঙ্গে ছায়ার মত আছে তবে ফুট-ফরমাস করার কোন সুযোগ পাওয়া পাচ্ছে না। হারিকেনটা হাতে নিয়ে হাঁটলেও কিছু কাজ হত। নীতু হারিকেন হাতছাড়া করছে না। পুষ্পকে নীতুর খুব পছন্দ হয়েছে। শুধু সেয়েটা যদি একটু ফর্সা হত! মেয়েটা ভয়ংকর কালো। নীতু পুষ্পকে দেখে প্রথমেই বলেছে–তুমি এত কালো কেন?
পুষ্প তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছে–খালাম্মা, আমরা তো গরীব মানুষ এই জন্যে কালো।
গরীব মানুষ হলেই কালো হয়।
জ্বি খালাম্মা, হয়। বালা বালা সাবান না মাখলে কি আর শইল্যে রঙ ফুটে? গরীব মাইনষে সাবান কই পাইব!
শোন, আমাকে খালাম্মা ডাকছ কেন?
কি ডাকমু?
তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমাকে নীতু ডাকবে।
আফনে কি যে কন! ছিঃ, ছিঃ। থুক।
পুষ্প থু করে একদলা থুথু ফেলল। নীতু রাগী গলায় বলল, ছিঃ ছিঃ বলে থুথু ফেললে কেন? ঘরের ভেতর থুথু ফেলা নোংরামি। থুথুতে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া চারদিকে রোগ ছড়ায়। বুঝতে পারছ?
পুষ্প তেমন কিছু বুঝল না তারপরও বলল, পারতাছি।
তুমি অনেক কিছুই জান না। আমার কাছ থেকে শিখে নিবে। গরীব হলে গায়ের রঙ কালো হয় না। আর যদি গায়ের রঙ কালো হয় সাবান মেখে কিছু হবে না। অনেক ধনী মানুষের কালো কালো মেয়ে আছে। আমার এক বান্ধবী আছে, তৃণা নাম–ও ভয়ংকর কালো। ওর সাবানের অভাব নেই।
ভাল সাবান দিলে কাম হয়।
কোন সাবানেই কাজ হয় না। তুমি লেখাপড়া জান?
জ্বে না। সে কি! সত্যি জান না?
জ্বে না।
আমরা তো এখানে আরো নদিন থাকব। এই কদিনে তোমাকে আমি লেখাপড়া শিখিয়ে দেব। আজ প্রথম দিনে পড়াব না। কাল বই-খাতা নিয়ে আসবে।
বই-খাতা কই পামু?
বই-খাতাও নেই? আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করব।
পুষ্পকে নীতুর খুব পছন্দ হলেও মাঝে মাঝে মেয়েটার বোকামি ধরনের কথায় গা জ্বলে যেতে লাগল। যেমন–নীতু অন্দর বাড়ি থেকে বাংলোঘরে যাবে–পুষ্প বলল, একটু খাড়ান বুবু, চুল বাইন্দা দেই।
নীতু বলল, কেন?
অহন সইন্ধাকাল তো। সইন্ধাকালে চুল বান্দা না থাকলে জীন-ভূতে ধরে।
চুল বাঁধা থাকলে ধরে না?
জ্বে না।
কেন?
চুল খোলা থাকলে চুলের আগা বাইয়া এরা শইল্যে উঠে। চুলের আগা না ধরলে এরা উঠতে পারে না।
আজেবাজে কথা আমাকে কখনো বলবে না পুষ্প। আজেবাজে কথা শুনলে আমি খুব রাগ করি। ভূত-প্রেত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।
আফনেরার শহর-বন্দরে নাই। আমরার গেরামদেশে আছে।
কোথাও নেই। ভূত-প্রেত সব মানুষের বানানো।
তাইলে বুবু আফনেরে একটা গফ কই, শুইন্যা নিজেই বিবেচনা করেন–গত বছর বইস্যা মাসে… বাপজান গেছে হাটে। টেকা লইয়া গেছে। কুসুম বুর জন্যে শাড়ি কিনব। কুসুম হইল আমার বুবুর নাম। আমরা তিন ভইন ছিলাম। মাইঝলা ভইন পানিত ড়িবা মারা গেছে। হেইডাও জ্বীনের কারবার। আফনেরে পরে বলব। যেটা বলতেছিলাম–বুবুর জন্যে বাপজান শাড়ি কিনব। মুসুল্লীর হাট। নৌকা লইয়া গেছে। মুসুল্লীর হাট তো আফনের হাতের তালুর মইদ্যে না–মেলা দূর। ফিরতে দিরং হইছে। নৌকা বাইয়া একা আসতাছে, হঠাৎ শুনে কাশির শব্দ। কে জানি কাশে। নৌকার মইদ্যে লোক নাই জন নাই, কাশে কে? বাপজান চাইয়া দেখে–নৌকার ছইয়ের ভিতরে সুন্দরপানা একটা মাইয়া। পান খাইয়া ঠোঁট করছে লাল। পরনে আগুনের লাহান এক শাড়ি। পায়ে আলতা। বাপজান অবাক হইয়া বলল–আফনে কেডা?
মেয়েছেলেটা সুন্দর কইরা হাসল, তারপরে বলল, আমি কে তা দিয়ক প্রয়োজন? তোমার নৌকা বাওনের কাম, তুমি নৌকা বাও।
বাপজানের মনে খুব ভয় হইল। সইন্ধাকালে কি বিপদ! তার আর হাত চলে না। নৌকার বইঠার ওজন মনে হয় তিন মন। মেয়েছেলেটা বাপজানরে কলল–ও মাঝির পুত মাঝি, নৌকা বাওন তোমার কাম, তুমি নৌকা বাও। খবরদার, আমারে আড়ে আড়ে দেখবা না। তোমার পুটলির মধ্যে কি?
বাপজান বলল, শাড়ি। নয়া শাড়ি। কুসুমের জন্যে কিহি আমার বড় মাইয়া।
তোমার মাইয়ার নয়া শাড়ি আমি অখন পরব। খবরদার, শাড়ি বদলানির সময় আড়ে আড়ে আমারে দেখবা না। দেখলে নিজেই ভয় পাইবা।
এই বইল্যা সেই মাইয়া নিজের পরনের শাড়ি এক টানে খুইল্যা ফেলল। বাপজান দেখব না দেখব না ভাইব্যাও একক তাকাইল। তার শইলের রক্ত ঠাণ্ডা অইয়া গেল।
নীতু ভীতু গলায় বলল, উনার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হল কেন?
পুষ্প ফিস ফিস করে বলল, কারণ বাপজান তাকাইয়া দেখে, এই মেয়েছেলের বুকে তিনটা দুধ। দেইখ্যাই বাপজান এক চিৎকার দিয়া ফিট পড়ছে। ফিট ভাঙলে দেহে–ঘাটে নৌকা, মেয়েছেলেটা নাই।
তোমার বাপজান এই গল্প তোমাদের বলেছেন?
না, আমরারে বলে নাই। মারে বলছে–গেরামের লোকরে বলছে।
তোমরা বিশ্বাস করছ?
বিশ্বাস না করনের কি? বিলের মইধ্যে ডাকিনী মেয়েছেলে থাকে… এবারে কয় মায়া ডাকিনী।
নীতু রাগী গলায় বলল, বিলের মধ্যে মাছ ছাড়া আর কিছু থাকে না। তোমার বাপজান বানিয়ে বানিয়ে এই গল্প করেছেন। কারণ তোমার বুবুর শাড়ি কেনার কথা। ছিল তো। তিনি শাড়ি না কিনে টাকাটা অন্য কোথাও খরচ করে ফেলেছেন কিংবা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই তিনি একটা গল্প বানিয়েছেন। তোমরা বোকা তো, তোমরা বিশ্বাস করেছ।
পুষ্প হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। নীতু বলল, হাসছ কেন?
বাপজান কিন্তুক বুবুর শাড়ি আনছে। ঐ মেয়েছেলে শাড়ি থুইয়া গেছে। যেমন ভঁজ ছিল তেমন ভঁজে ভঁজে রাইখ্যা গেছে। তয় বুবু এই শাড়ি পিন্দে না। মা কয়–জ্বীন-ভূতের পরা শাড়ি শইল্যে দিস না। শাড়ি ঘরে তোলা আছে–লাল শাড়ি–আফনেরে দেখামু নে।