শাহানা শোবার ঘরে ঢুকল। নীতু গম্ভীর ভঙ্গিতে কি যেন লিখছে। নীতুর লেখালেখির সময় আশেপাশে না থাকাই ভাল। সে একটু পর পর বানান জিজ্ঞেস . করবে। শাহানা আবার বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় মাছ কাটা হচ্ছে। প্রকাণ্ড এক চিতল মাছ–তিনজন লাগছে মাছ কাটতে। দুজন মাছ ধরে আছে, একজন বটি। প্রতিদিনই কি এমন সাইজের মাছ আনা হবে?
ইরতাজুদ্দিন বেতের মোড়ায় বসে আছেন। নাতনীর দিকে তাকিয়ে বললেন–আয়, মাছ কাটা দেখে যা।
জীবন্ত একটা প্রাণীকে কাটা হবে। সেই দৃশ্য পাশে দাঁড়িয়ে দেখার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। দাদাজানকে এই কথা বুঝানোও যাবে না। শাহানা তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন এগিয়ে এলেন–
চোখ বড় বড় করে কি দেখছিস?
বাড়ি দেখছি। কি প্রকাণ্ড বাড়ি! এত বড় বাড়ি বানানোর দরকার কি?
বাড়ি বড় না হলে মন বড় হয় না।
শাহানা হাসতে হাসতে বলল, ঠিক বলেননি দাদাজান, এই পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় মনের মানুষের জন্ম হয়েছে ছোট ছোট বাড়িতে। অন্ধকার খুপরিতে।
ভূল তর্ক আমার সঙ্গে করবি না। রবীন্দ্রনাথ কি খুপরি ঘরে জন্মেছেন? টলস্টয় ছিলেন জমিদার। তুই দশটা বড় মনের মানুষের নাম বল যে খুপরি ঘরে জন্মেছে। খুপরি ঘরে থাকলে মনটাও খুপরির মত হয়ে যায়…
শাহানা খুব চেষ্টা করছে দরিদ্র ঘরে জন্মানো কিছু ভুবন-বিখ্যাত মানুষের নাম মনে করতে, মনে পড়ছে না। অথচ সে জানে তার কথাই ঠিক। নামগুলি এক সময় মনে পড়বে, তখন কোন কাজে আসবে না।
ইরতাজুদ্দিন বললেন, বাড়ি পছন্দ হয়েছে কি না বল।
হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে। খুব পছন্দ হয়েছে–ছাদে যাবার ব্যবস্থা থাকলে আরও পছন্দ হত।
ছাদে যেতে চাস? সেটা কোন ব্যাপারই না, মিস্ত্রি ডাকিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে লাগিয়ে দেব।
দরকার নেই দাদাজান।
ইরতাজুদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন, অবশ্যই দরকার আছে। আমার বংশের একটা মেয়ে, তার শখ হয়েছে, সেই শখ মেটানো হবে না তা হয় না।
এই বংশের মানুষদের সব শখ মেটানো হয়?
যতক্ষণ ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ মেটানো হয়। আমার যে দাদাজান তার একবার শখ হল আম খাবেন। তখন মাঘ মাস–কোথায় পাওয়া যাবে আম? শখ বলে কথা–সেই আম জোগাড় করা হল–পাঞ্জাব থেকে আনা হল। সেই আমলে আম আনতে খরচ হয়েছিল সাত হাজার টাকা।
আম খেয়ে উনি খুশি হয়েছিলেন?
অবশ্যই হয়েছিলেন। শখ মেটাতে পেরেছেন এটাই খুশির ব্যাপার।
উনি কি উনার সব শখ মিটিয়ে যেতে পেরেছিলেন?
তা জানি না।
আপনি কি আপনার সব শখ মেটাতে পেরেছেন?
ইরতাজুদ্দিন জবাব দিলেন না। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। শাহানা বলল, দাদাজান, মতি বলে যে ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে এসেছিলেন তাকে রাতে আমাদের সঙ্গে খেতে বলুন তো।
ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, কেন?
বেচারা খুব কষ্ট করে আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন।
আপনি আপনি করছিস কেন?
আপনি বলব না?
অবশ্যই না। আপনি–তুমি–তুই এইগুলি সৃষ্টি ইয়েছে কেন? প্রয়োজন আছে বলেই সৃষ্টি হয়েছে। ফকির যখন ঢাকায় তোদের বাসায় ভিক্ষা চায় তখন তুই কি বলিস–যাও মাফ কর, না- কি দয়া করে ক্ষমা করুন?
ফকির আমাদের বাসায় আসতে পারে না। দুজন দারোয়ান, তিনটা এলসেশিয়ান কুকুর ডিঙিয়ে আসা সম্ভব না। অবশ্যি গাড়ি করে যাবার সময় মাঝে মাঝে ভিক্ষা চায়–তখন কিন্তু আমি আপনি বলি–তুমি বলি না, তুই বলি না।
এখানে বলতে হবে। আজ তুই মতি গাধাটাকে আপনি বলবি, সে লাই পেয়ে যাবে, ভাববে… সমানে সমান।
দাদাজান আপনি পুরানো দিনের জমিদারদের মত কথা বলছেন। একটা মানুষ গরীব হলেই তাকে তুই বলতে হবে?
ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন–তোদের বয়সে এইসব আদর্শবাদী কথা বলতে ভাল লাগে। শুনতেও ভাল লাগে। এই বয়সে মনে হয় মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। ভেদাভেদ অবশ্যই আছে। তোর কাছেও আছে। মতি হল এই গ্রামের অপদার্থ একজন বাউন্ডেলে। কাজকর্ম কিছুই করে না–ঘুরে বেড়ায়–জ্ঞানীর মত কথা বলার চেষ্টা করে। গানের দল করেছে–দলের কাজ হল রাত জেগে হুল্লোড় করা–সব কটা চোর একত্র হয়ে…
শাহানা অবাক হয়ে বলল, এই ভাবে কথা বলছেন কেন? তাকে পছন্দ করেন না–ভাল কথা–চোর বলার দরকার কি?
ইরতাজুদ্দিন কিছুক্ষণ কড়া চোখে নাতনীর দিকে তাকিয়ে বাংলোঘরের দিকে রওনা হলেন! ছাদে ওঠার সিড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।
কাঠের সিঁড়ি সন্ধ্যা নাগাদ পঁড়িয়ে গেল। সিড়ি খানিকটা নড়বড়ে। একজনকে সিড়ির গোড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ইরতাজুদ্দিন কাঠ মিস্ত্রিকেই রেখে দিয়েছেন। দশদিন সে এ বাড়িতেই থাকবে, খাবে–তার নাতনীরা যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠবে-নামবে সে সিড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। নড়বড়ে সিড়ি বানানোর এই তার শাস্তি।
শাহানার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে ইচ্ছা করল না। সে ছাদে হাঁটবে আর একজন সিড়ির কাছে অপেক্ষা করবে–কখন সে ছাদ থেকে নামবে–খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার। দরকার নেই তার ছাদে যাওয়ার।
শুরুতে নীতুর যত খারাপ লেগেছে এখন আর তত খারাপ লাগছে না। হরিকেন হাতে নিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে নীতুর ভাল লাগছে। হারিকেন তার খুব পছন্দ হয়েছে–হারিকেনে নিজের চারপাশটাই শুধু আলোকিত হয় আর সব অন্ধকার। নীতুর একা একা ঘুরতে খারাপ লাগত–এখন স্রে একা একা যাচ্ছে না। ইরতাজুদ্দিন নীতুর বয়েসী একটা মেয়েকে খবর দিয়ে এনেছেন–মেয়েটার নাম পুষ্প। তার কাজ হচ্ছে নীতুর সঙ্গে থাকা, তার ফুট-ফরমাস করে দেয়া।