শাহানা ভুল পথ বেছেছে। কিছুদূর গিয়েই পথ শেষ হয়ে গেল। ঘন জঙ্গল শুরু হল। জঙ্গলের ভেতর ঢোকার কোন প্রশ্ন ওঠে না।(শ্রাবণ মাসের জঙ্গল–মাটিতে হাঁটু-উঁচু ঘাস জমে আছে–নিশ্চয়ই সাপখোপ কিলবিল করছে। বাঁ পাশে উঁচু ঢিবির মত আছে। তার বাঁধের ওপাশে হাওড়। শাহানা কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ফিরে যাবে, না বাঁধের ছোট পাহাড়টায় উঠবে?
আচ্ছা, এই সমতল ভূমিতে হঠাৎ এরকম উঁচু একটা জায়গার মানে কি? ডেবে যাওয়া পুরোনো কোন মঠ-টঠ না তো? আর্কিওলজী বিভাগ কি জানে এই জায়গা সম্পর্কে? ঢিবির উপর উঠে দেখার মত কিছু কি আছে? না থাকারই কথা। তবু উঁচু জায়গা দেখলেই মানুষের উঠতে ইচ্ছে করে। শুধুমাত্র এই কারণেই শাহানা উঠা ঠিক করল। হিল পায়ে বাধে উঠা যাবে না। খালি পা হতে হবে। তার নীতুর মত শুচিবায়ু নেই, তবু পা থেকে জুতা খুলতে মন সায় দিচ্ছে না।
হঠাৎ পেছন থেকে তীক্ষ্ণ গলায় কে ডেকে উঠল–আপনে কে গো? আপনে কে?
হিল পায়েই শাহানা অনেকখানি উঠে পড়েছিল। সেইখানেই সে থামল। পেছন ফিরল। শ্যামলামত হালকা-পাতলা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার চোখে গভীর কৌতূহল। মেয়েটার হাতে বাঁশের খলুই। আশ্চর্য মিষ্টি চেহারা তো মেয়েটির! মেয়েটা আগের মতই তীক্ষ্ণ গলায় বলল–নামেন কইলাম। নামেন। তাড়াতাড়ি নামেন।
কেন?
সাপে ভর্তি। এইটার নাম–মা মনসার ভিটা। এক্ষণ নামেন।
তোমার নাম কি?
নাম পরে শুনবেন। আগে নামেন। প্রতি বছর এই জায়গায় সাপের কামড়ে গরুবাছুর মরে।
আমি তো গরুবাছুর না।
মানুষও মরে। গত বাইস্যা মাসে মরছে একজন।
এতদূর ওঠে সাপের ভয়ে নেমে যাওয়া ঠিক না–আরো খানিকটা উঠা যাক। ঝাঁঝালো রোদে সাপ বের হয় না। তাদের চোখ আলো সহ্য করতে পারে না। শাহানা তর তর করে উপরে উঠে গেল। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে তাকে দেখছে। ঢিবিটায় শেষ পর্যন্ত না উঠলে মেয়েটার হতভম্ব মূর্তি দেখা যেত না। বড় রকমের একটা মজা থেকে সে বঞ্চিত হত। শাহানা নেমে আসছে। নামাটা কঠিন মনে হচ্ছে হিল খুলতেও সাহস হচ্ছে না। সাপের কথা বলে মেয়েটা ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
হিল না খুলেই শাহানা নামল। শাহানা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটা বলল, আপনে কে?
সহজ সপ্রতিভ ভঙ্গি। গ্রামের মেয়েরা এমন আগবাড়িয়ে কথা কি বলে? বোধহয় না। দরজার আড়াল থেকে উঁকি-ঝুঁকি দিতেই তারা পছন্দ করে।
আমার নাম শাহানা। আমি ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বড় নানী। তুমি কে?
আমি কেউ না।
কেউ না মানে কি? তোমার তো একটা নাম আছে। না-কি নামও নেই?
আমার নাম কুসুম।
খলুইতে কি?
গোবর। গোবর টুকাইতে বাইর হইছি। এর মধ্যে আপনেরে দেখলাম। আফনের বেজায় সাহস–মনসার ভিটাতে কেউ উঠে না।
শীতের সময়ও উঠে না? তখন তো সাপ থাকে না।
জ্বি না, শীতের সময়ও না।
এই জায়গাটা এমন উঁচু কেন জান?
আল্লাহ তাকে উঁচা কইরা বানাইছে, এই জন্যে উঁচা।
শাহানা হেসে ফেলল। কুসুমও হাসছে। শাহানা বলল–গোবর দিয়ে কি করবে? সার বানাবে?
খড়ি করব।
এই বিশ্রি জিনিশটা হাতে মাখতে খারাপ লাগে না?
জ্বে না। খারাপ লাগবে ক্যান?
শাহানা হাসিমুখে বলল, আমার একটা ছোট বোন আছে–ওর নাম নীতু। নীতুর পায়ে গোবর লেগেছিল। সে পুরো একটা সাবান পায়ে ঘষে শেষ করেছে। এখন গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।
কুসুম বলল, আফনেরা রাজবাড়ির মেয়ে, আফনেরার কথা আলাদা।
আমরা বুঝি রাজবাড়ির মেয়ে?
জ্বি।
রাজা থাকলে তবেই না রাজবাড়ি হয়। রাজা কোথায়?
রাজবাড়ি যার থাকে হেই রাজা।
মেয়েটা শুধু যে সপ্রতিভ তাই না–লজিক নিয়ে খেলতেও পছন্দ করছে। বেশ তো। শাহানা বলল, তোমাদের বাড়ি কোষ্টা? কুসুম উৎসাহের সঙ্গে কাল–ঐ যে দেখা যায়। যাইবেন আমরার বাড়িত?
হ্যাঁ যাব।
আফনেরে বুবু বললে আফনে কি রাগ হইবেন?
না, রাগ হব না।
কুসুম উজ্জ্বল চোখে তাকাল। খুশি খুশি গলায় বলল, বুবু আসেন।
শাহানার যাওয়া হল না। সে অবাক হয়ে দেখল, তার দাদাজান প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন। এভাবে আসতে তাঁর যে কষ্ট হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে। তাঁর ফর্সা মুখ লাল টকটক করছে। তিনি খুব ঘামছেন।
ইরতাজুদ্দিনের পেছনে পেছনে দুজন কামলাও আছে। একজনের হাতে ছাত ধরা। তারাও পাচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন থমথমে গলায় বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড! তুই কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে এলি একা একা? আর কখনো যেন এরকম না হয়। কখনো না।
তিনি পথের উপরই বসে পড়েছেন। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন। শাহানার মনে হল, এই মানুষটার হার্টের কোন সমস্যা আছে। নয়ত ওভাবে পথের উপর বসে এত শব্দ করে শ্বাস নিতেন না। হার্ট বিশুদ্ধ রক্ত ঠিকমত সমস্ত শরীরে পৌঁছে দিতে পারছে না।
কুসুম পুখ থেকে নেমে পড়েছে। ভীত ভঙ্গিতে ইরতাজুদ্দিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরতাজুদ্দিন কড়া চোখে কুসুমের দিকে তাকালেন। কুসুম আরও সংকুচিত হয়ে পড়ল। তিনি নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। শাহানার দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন–আর কখনো এরকম করবি না। আয় আমার হাত ধর। চল যাই।
আকাশ দেখে কে বলবে
আকাশ দেখে কে বলবে কাল রাতে এত বর্ষণ হয়েছে? শাহানার চোখ বার বার আকাশে চলে যাচ্ছে। রোদ উঠেছে কড়া। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। শাহানা চায়ের কাপ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বাড়ির সবই বড় বড়, শুধু চায়ের কাপগুলো ছোট। শাহানার অভ্যাস মগভর্তি চা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া। শুরুতে মগের চা গরম থাকে, আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হতে থাকে। সেটা টের পাওয়া যায় না।