তুমি আমার সালাম নিও। দাদাজান আমাকে দিয়ে জোর করে চিঠি লেখাচ্ছেন। তোমার কাছে নাকি ঐ চিঠি হাতে হাতে পৌঁছানো হবে।
আমরা সুখানপুকুর ঠিকমত পোঁছেছি। পথে কোন অসুবিধা হয়নি। শুধু ঠাকরোকোনা স্টেশনে পায়ে গোবর লেগে গিয়েছিল। তার কি যে কড়া গন্ধ! এখনও যাচ্ছে না। আমি এ বাড়ির বুয়াকে গরম পানি করতে বলেছি। গরম পানিতে আজ সারাদিন পা ড়িবিয়ে রাখব।
এদিকে আমাদের খুব একটা খারাপ খবর আছে। ভয়ংকর খারাপ। দাদাজান বলছেন দশদিন থাকতে হবে। দশদিনের আগে তিনি আমাদের ছাড়বেন না। আপা হাল ছেড়ে দিয়েছে, আমি এখনও হাল ছাড়িনি। আমি খুব চেষ্টা করছি দাদাজানকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুই-তিন দিন থেকে চলে আসতে। দাদাজান হয়ত বুঝতে চাইবেন না। কিছু কিছু মানুষ আছে–অন্যের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে পারে না।
তবে জায়গাটা খুব সুন্দর। অবশ্য দশদিন ধরে দেখার মত সুন্দর না।
যদি দশদিন থাকতে হয় তাহলে আমি খুব বিপদে পড়ব। কারণ আমি মাত্র দুদিন পড়ার জন্য গল্পের বই নিয়ে এসেছি।
বাবা শোন, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার যে বন্ধু আছে–মনীষা–তাকে টেলিফোন করে হ্যাপি বার্থডে দিতে হবে। তার জন্মদিন ১৭ তারিখ। তার টেলিফোন নাম্বার ৮১ ৩২ ১১।
চিঠি লেখার কাগজ শেষ হয়ে গেছে–চিঠি এখানেই শেষ করলাম। এবার তাহলে ৬০ + ২০
ইতি
নীতু
পুনশ্চ : বাবা, তোমার বাবাকে আমার মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। খুব বেশি পছন্দ হয়নি।
নীতু এক গামলা গরম পানিতে তার পা ডুবিয়ে রেখেছে। গোবরের গন্ধ দূর করার একটা চেষ্টা। তার হাতে গল্পের বই। সে খুব ধীরে ধীরে পড়ছে। তাড়াতাড়ি পড়লেই বই শেষ হয়ে যাবে। মস্তবড় ভুল হয়েছে–অনেকগুলি বই নিয়ে আসা উচিত ছিল।
শাহানা বোনের কাণ্ড দেখল। তাকে মনে মনে স্বীকার করতেই হল নীতু খুব গোছানো মেয়ে। এর মধ্যেই গরম পানি গামলা সব জোগাড়যন্ত্র করে ফেলেছে। বেশ শান্ত শান্ত ভঙ্গি করে গল্পের বই নিয়ে বসেছে। যেন সে এ বাড়ির একজন কর্ত্রী। শাহানা বলল, ঘুরতে যাবি না-কি রে?
নীতু নাসূচক মাথা নাড়ল। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাল না। শাহানা বলল, চল হেঁটে আসি–তুই তোর পায়ে আরও খানিকটা গোবর মাখার সুযোগ পেয়ে যাবি। স্টেশনের গোবরের মত বাসি গোবর না, টাটকা গোবর। এর মজাই অন্য রকম।
আপা, বিরক্ত করবে না। প্লীজ।
গ্রাম দেখে আসি চল্।
গ্রাম আমার দেখতে ভাল লাগে না। গ্রামের গল্প বই-এ পড়তে ভাল লাগে, দেখতে ভাল লাগে না।
বেশিক্ষণ পা পানিতে ড়িবিয়ে রাখবি না। সমস্যা হবে।
কি সমস্যা হবে?
মাছের মত তোর পায়ে আঁশ বেরিয়ে যেতে পারে। শেষে দেখা যাবে মৎস্যকন্যা হয়ে গেছিস।
তুমি সব সময় ঠাট্টা কর আপা। মাঝে মাঝে ঠাট্টা ভাল লাগে না…
তুই যাবি না তাহলে?
না।
শাহানা একাই বের হল। কেউ তাকে লক্ষ্য করল না।
শাহানার সবচে বড় ভয় ছিল কাদার ভয়। দেখা গেল ভয় অমূলক। কাদা তেমন নেই। হাঁটার জন্যে কাদাবিহীন শুকনো জায়গা যথেষ্ট আছে। সাবধানে হাঁটলেই হয়। অস্বস্তির ব্যাপার একটাই–মাঝে মাঝে শাড়ি খানিকটা টেনে তুলতে হচ্ছে।
হাঁটতে শাহানার অসম্ভব ভাল লাগছে–ছায়াঢাকা পথ কথাটা বই-টইয়ে পাওয়া যায়–এই প্রথম সে ছায়াঢাকা পথ দেখলকড় বড় ছাতিম গাছ সারা পথ জুড়ে এমনভাবে ছড়ানো যেন মাথার উপুর ছাতা ধরার জন্যেই এরা আছে। পথের একদিকে বেতবন। শাহানা চিনতে পারল বেত ফল দেখে থোকায় থোকায় ফলে আছে। কিছু বেতফল কি সে ছিঁড়ে নিয়ে নেবে? নীতু দেখলে মজা পেত।
পথে হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম সম্পর্কে শাহানার ধারণা কিছু কিছু পাল্টাচ্ছে। যেমন ঘুঘুপাখির ডাক। শাহানার ধারণা ছিল, ঘুঘুপাখি শুধু ভরদুপুরেই ডাকে। এখন দেখা যাচ্ছে তা না, এরা সারাক্ষণ ডাকে। পাখিরা মোটেই শান্ত এবং চুপচাপ ধরনের না–এরা বেশ ঝগড়াটে এবং সারাক্ষণ কিচির-মিচির করতে ভালবাসে।
শাহানা লক্ষ্য করল, বিভিন্ন বাড়ি থেকে মেয়েরা উঁকি-ঝুঁকি মেরে তাকে দেখছে। সে কোন পুরুষমানুষ না, মেয়েরা তাকে এমন আড়াল থেকে দেখছে কেন কে জানে। শাহানা তাকালেই এরা আবার দ্রুত সরে যাচ্ছে। পুরুষমানুষ তেমন চোখে পড়ছে না। সবাই বোধহয় কাজে চলে গেছে। শ্রাবণ মাসে হাওড় অঞ্চলের পুরুষদের তেমন কাজ থাকার কথা না–এরা গেছে কোথায়? ছোট ছোট ছেলেমেয়ে প্রচুর চোখে পড়ছে। এরা কেমন ভয়ে ভয়ে শাহানাকে দেখছে। তাকে এরা ভয় পাচ্ছে। কেন? একটা ঐ দশ বছরের মেয়ে ভয় জয় করে শাহানার পেছনে পেছনে আসতে শুরু করেছিল। পেছন থেকে তার মা তাকে ডেকে থামিয়ে দিল।
পথটা এখন তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। শাহানা দাঁড়িয়ে আছে। তিনপথের কোনটায় সে যাবে বুঝতে পারছে না। যদিও তিনটা পথই তার কাছে এক রকম। একটায় গেলেই হয়। সে নিরিবিলি কিছুক্ষণ হাঁটতে চায়–কাজেই এমন পথ তাকে বাছতে হবে যেখানে লোকজন কম চলাফেরা করে। সেটা বের করা তেমন কঠিন কিছু না, পথের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কোন পথে লোক চলাচল কম।
হারিয়ে যাবার ভয় নিশ্চয়ই নেই। এত ছোট জায়গায় কেউ হারায় না। আর যদি সে হারিয়ে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। বললেই হবে–রাজবাড়িতে যাব। তাদের বাড়িটা হল রাজবাড়ি। সেই অর্থে রাজবাড়ির মেয়ে হয়ে সে হল রাজকন্যা। দি প্রিন্সেস।
রাজকন্যা একা একা হাঁটছে–প্রজারা সব দূর থেকে আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে দেখছে। মজার ব্যাপার তো। তার বেশভূষা ঠিক রাজকন্যার মত না। শাড়ি আরও জমকালো হলে ভাল হত। সাদামাটা সুতির শাড়ি। গায়ে কোন গয়না নেই। রাজকন্যার থাকবে গা ভর্তি গয়না। জড়োয়া গয়না। আলো পড়ে পাথর চিকমিক করতে থাকবে।