কোন গান?
কুসুম তখন গুন গুন করে গাইত—
তুই যদি আমার হইতি
আমি হইতাম তোর।
কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর…
মতি অবাক হয়ে বলত–তোমার গলা তো বড় সৌন্দর্য কুসুম।
হ্যাঁ, কুসুমের গলা অনেক সৌন্দর্য। মতি সেটা জানে না। মেয়েছেলে হয়ে তো সে গানে টান দিতে পারে না। মেয়েছেলে গানে টান দিলে সাথে সাথে জ্বীনের আছর হয়। সংসারে অমঙ্গল হয়। পুরুষছেলে গানে টান দিলেই সংসার টিকে না–এই যে মতি ভাল ছিল, সুখে ছিল, যেই গানের টান দিল ওমি সব গেল। ঘর নাই, বাড়ি নাই, সংসার নাই।
কুসুমের প্রায়ই ইচ্ছা করে, যদি শুধু সে আর মতি মিলে একটা গানের দল দিত! আর কেউ না, শুধু তারা দুজন।
কুসুমের মা মনোয়ারা ঘরের ভেতর থেকে ঝাঝালো গলায় ডাকলেন, কুসুম, ও কুসুম। কুসুম বিরক্ত মুখে উঠে গেল।
মনোয়ারা তিক্ত গলায় বললেন–ছেলেটা পানি চাইছে, তুই যে দিলি না!
দেখ না হাত বন্ধ। পানি কি দিয়া দিমু? পাও দিয়া?
এটা কেমন কথা! পানি চাইছে–হাত ধুইয়া পানি দিবি। পানি চাইছে পানি পাইল না–এইটা কেমন কথা… সংসারে তুই অলক্ষণ ডাইক্যা আনতেছস।
আনতেছি ভাল করতেছি?
পুষ্প কই? পুষ্প!
পুষ্প কই আমি কি জানি। পুষ্প তো ছাগল না যে দেইখ্যা রাখব।
তোর কথাবার্তা এই রকম ক্যান?
আমি যেমন মানুষ–তেমন কথাবার্তা।
সামনে থাইক্যা যা কুসুম। যা কইলাম। তোরে দেখলে শইল জ্বলে।
কুসুম বাড়ির পেছনের ডোবায় হাত ধুয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে রান্নাঘরে ঢুকল। মনোয়ারা পেছনে পেছনে ঢুকলেন। কুসুম তেলের শিশি হাতে নিচ্ছে।
যাস কই?
তেল আনতে যাই।
তোর বাপ না তোরে ঘরের বাইর হইতে নিষেধ করছে!
ঘোমটা দিয়া যামু, ঘোমটা দিয়া আসমু। তেল ছাড়া রান্ধা হইব না।
না হইলে না হইব। খবর্দার, তুই ঘরের বাইর হবি না।
কুসুম কিছু বলল না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল সে যাবেই। মনোয়ারার ইচ্ছা করছে চুলের মুঠি ধরে মেয়েকে আছড়ে উঠানে ফেলে দিতে। সাহস হচ্ছে না। ভয়ংকর জেদী মেয়ে, কি করে বসবে কে জানে!
তোর যে বিয়া হয় না–চালচলনের জন্যে হয় না। সম্বন্ধ আফনাআফনি আসে না–খোঁজখবর নিয়া আসে। তোর খোঁজখবর যা পায়…
কুসুম মার কথা শেষ করতে দিল না। তার আগেই বের হয়ে পড়ল। মজিদের দোকানে তেল আনতে যাচ্ছে। হাতের কাছে দোকান। আগেও অনেকবার গিয়েছে। মজিদ সম্পর্কে চাচাতো ভাই হয়–এমন কিছু ভয়ংকর অপরাধ কুসুম করছে না। তারপরেও মনোয়ারার গা জ্বলে যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না এটা তার কাছে সৌভাগ্যের মত মনে হচ্ছে। যে বিশ্রি স্বভাব কুসুমের হয়েছে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছুদিনের মধ্যেই শাড়িতে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে।
কুসুম মজিদের দোকানে তেল আনতে যায়নি। সে মোটামুটি নিশ্চিত মতিকে দোকানেই পাবে। জ্বর যা এসেছে তাতে দোকানের একপাশে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকার কথা। পানি খেয়েছে কি-না কে জানে। জ্বরে পিয়াসের পানি না পেলে শরীর চড়ে যায়।
মতি দোকানে ছিল না। মজিদ একা তালমিছরি মুখে দিয়ে বিরস মুখে বসে আছে। কুসুমকে তার বেশ পছন্দ। বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে না, কারণ গরীব ঘরের মেয়ে, একে বিয়ে করলে কিছুই পাওয়া যাবে না। সৌন্দর্য দিয়ে কি হয়–দু-তিনটা ছেলেপুলে হলেই সৌন্দর্য শেষ। সময়ের সঙ্গে সব নষ্ট হয়, শুধু টাকাপয়সা নষ্ট হয় না। টাকাপয়সা বাড়ে। তেলের শিশি এগিয়ে দিতে দিতে কুসুম বলল, মতি ভাইরে দেখছেন?
মজিদ সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, তেল কতখানি দিমু?
তিন আঙ্গল।
আঙ্গুলের হিসাব আমার দোকানে নাই। হয় এক ছটাক নাও, নয় এর কমে আধা ছটাক।
তিন আঙ্গুলে যতদূর হয় দেন–মতি ভাইরে দেহেন নাই?
দেখছি, পানি খাইতে আইছিল। আমি পানির মটকি নিয়া দোকানে বসছি? তেল দিলাম এক ছটাক। নগদ পয়সায় খরিদ করণ লাগব। টেকা আনছ?
কুসুম নিঃশব্দে শাড়ির আঁচল থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে দিল। কুসুমের মন খুবই খারাপ হয়েছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি দোকানের সামনে থেকে চলে যেতে পারে ততই মঙ্গল।
মতি ভাই গেছে কোনদিকে জানেন?
না। দোকান লইয়া কুল পাই না–কে কোনদিকে গেছে অত খোঁজ ক্যামনে রাখব?
আফনের দোকানে তো মাছিও বসে না, অত বড় গলার কথা বেহুদা কন ক্যান?
ঝাঁঝালো ধরনের কথা বলায় কুসুমের লাভ হয়েছে–ভেজা চোখ শুকিয়ে আসছে।
মজিদ বলল, তালমিছরি খাইবা?
মাগনা দিলে খামু। দেন।
মজিদ এক টুকরা তালমিছরি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মনটা খারাপ করল। অকারণে মিছরি খরচ হয়ে গেল। কোন দরকার ছিল না।
মতি ভাইয়ের একটা খোঁজ নিতে পারলে ভাল লাগত। কিভাবে খোঁজ পাওয়া যায়? পুষ্প সকাল থেকেই নেই–সে থাকলে তাকে পাঠানো যেত। এইসব কাজে পুষ্প খুব সেয়ানা…।
কুসুম ক্লান্ত পায়ে ফিরছে। মজিদের সঙ্গে ঝাঁঝালো ধরনের কথা বলেও বিশেষ লাভ হয়নি। কুসুমের চোখ আবার ভিজে আসছে। যা করতে চায় না সব সময় সে সেই কাজটাই কেন করে? সবসময় সে ঠিক করে রাখে পরেরবার মতি ভাইয়ের সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন খুব ভাল ব্যবহার করবে। এত ভাল যে মতি ভাইকে চিন্তায় পড়ে যেতে হয়। কখনো তা করা হয় না। সে সম্পূর্ণ উল্টোটা করে। কেন সে এরকম হল? কেন? পানি চেয়েছিল, দিয়ে দিলেই হত। পানির গ্লাস হাতে দিয়ে সে তো বলতে পারত–জ্বর নিয়া কই যাইবেন বইস্যা যান। তাদের বাংলোঘর বলে কিছু নেই–বাংলোঘর থাকলে সেখানে কি করে দিতে পারত। অসুস্থ মানুষ শুয়ে থাকত বিছানায়।
আমার সালাম নিও
বাবা,