মতি বিস্মিত হয়ে বলল, বৌরে আমি খাওয়ামু কি? সামান্য জমি যা ছিল বাপজান বেচে টিনের ঘর করল। পানির কল দিল। পানি খাইয়া তো মানুষ বাঁচে না।
কাজকর্মের চেষ্টা দেখ।
কাজকর্ম জানি কি যে চেষ্টা দেখুম?
অসুখ-বিসুখ হলে শুধু পুরানো কথা মনে হয়। বাপজানের কথা মনে হওয়ায় মতির মন হঠাৎ খানিকটা খারাপ হয়ে গেল। বড় দুঃখী ছিল মানুষটা—বেচারার জন্যে যেন বেহেশত নসিব হয়।
জ্বরে মতির শরীর কাঁপছে। বিছানায় শুয়ে থাকলে জ্বর আরও বাড়বে। জ্বর এমন জিনিশ প্রশ্রয় পেলেই হু হু করে বাড়তে থাকে। ভালবাসা এবং জ্বর–এই দু জিনিশ প্রশ্রয় পেলে বাড়ে। এই বিষয়ে একটা গান থাকলে ভাল হত। মতি গান বাধতে পারে না। গান বাধতে পারলে এটা নিয়ে সুন্দর গান বেঁধে ফেলত। তার মাথায় নানান বিষয় নিয়ে সুন্দর সুন্দর গান বাঁধার ইচ্ছে করে। ক্ষমতা নেই বলে বাঁধতে পারে না। আল্লাহপাক সবাইকে সব ক্ষমতা দেন না।
মতি বিছানা থেকে নামল। উঠানের জলচৌকিতে কিছুক্ষণ বসল। মাথা ঘুরছে সামলে নিতে হবে। মাথা ঘুরে উঠানে পড়ে গেলে জ্বর ভাববে তার জিত হয়েছে, সে লাই পেয়ে মাথায় উঠে যাবে। তখন ডাক্তার আন রে, মাথায় পানি দাও রে…
পানির পিপাসায় বুক এখন ধড়ফড় করছে। ডাকলে যে কেউ আসবে সে উপায় নেই। তার ঘর পড়ে গেছে গ্রামের এক মাথায়। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটলে কুসুমদের বাড়ি। কোন মতে সেই বাড়িতে উপস্থিত হলে সেবা-যত্নের ত্রুটি হবে না! কুসুম তাকে দুচোখে দেখতে পারে না। তবুও সে অসুস্থ মানুষটাকে ফেলে দেবে না। কুসুমের বাপ মোবারক চাচা তাকে স্নেহ করেন। গত ঈদে সূতীর একটা পাঞ্জাবি কিনে পাঠিয়ে দেন। পাঞ্জাবিটা গায়ে ছোট হয়েছে। সেটা কোন কথা না, একজন দিয়েছে আদর করে। আদরটাই বড়। কুসুমের বাড়ি যাওয়া কি ঠিক হবে? মেয়েছেলের কেটকেটানী কথা শুনতে কার ভাল লাগে? আর একটু এগুলেই মজিদের দোকানঘর। মজিদ নতুন মুদির দোকান দিয়েছে। দোকান চলছে না। নগদ পয়সা ছাড়া মজিদ কিছু বেচে না। কার ঠেকা পড়েছে নগদ পয়সায় সওদা করার? গ্রামের মানুষ দোকান করেছে–বাকিতে জিনিশ দেবে, ধানের সময় হিসেবমত ধান নিয়ে নেবে। মজিদ ধানের ধার ধারে না–তার নাকি নগদ ব্যবসা।
মজিদ দোকান খুলে একা একা চুপচাপ বসে থাকে। কাঁচের বৈয়ম ভরতি তালমিছরি। মাঝে মাঝে তালমিছরির টুকর। মুখে ফেলে দেয়।
মতি মজিদের দোকানের একপাশে শুয়ে থাকবে সাব্যস্ত করল। পথে কুসুমের বাড়িতে থামবে–পানি খেয়ে যাবে। কুসুমের বাবা অনেকদিন বাইরে, উনার কোন খোঁজ খবর আছে কিনা তাও জানা দরকার।
কুসুমের বয়স কুড়ি হয়েছে। এই বয়সে গ্রামের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়–কুসুমের হচ্ছে না। সম্বন্ধই আসছে না কেন আসে না সেও এক রহস্য। তার গায়ের রঙ শ্যামলা–গরীব ঘরের বিয়েতে মেয়ের গায়ের রঙ তেমন প্রাধান্য পায় না। কুসুম দেখতে সুন্দর। চেহারার অতি কোমল ভাব অবশ্যি তার স্বভাবে নেই। তার জন্য কোন মেয়ের বিয়ে আটকে থাকে না। কুসুমের আটকে আছে। মনগড়ের পীর সাহেবের হলুদ সুতা গলায় বাঁধার পরও সম্বন্ধ আসছে না। মনগড়ের পীর সাহেবের সুতা গলায় দেয়ার এক মাসের ভেতর সম্বন্ধ আসার কথা। সব সময় আসে।
মতিকে দেখে কুসুম চোখ কপালে তুলে বলল, আফনের হইছে কি?
মতি উদাস গলায় বলল, কিছু হয় নাই। পানি খাব।
চউক করমচার মত লাল–হইছে কি? জ্বর?
না। পানি দেও দেখি।
পানি দিমু ক্যামনে? হাত বন্ধ দেহেন না?
কুসুমের হাত ঠিকই বন্ধ। মাটিগোবর মিশিয়ে মশলা বানাচ্ছে। ঘর লেপা হবে। কুসুমের পরনে সবুজ রঙের শাড়ি। মাথায় লম্বা চুল গাইনবেটিদের মত চুড়ো খোপা করা। সকালের রোদ পড়েছে তার চোখে-মুখে। কি সুন্দর তাকে লাগছে!
মতি বলল, পানির পিয়াস লাগছিল। ঘরে আর কেউ নাই?
না?
আইচ্ছা তাহলে যাই।
বসেন। হাতের কাম শেষ করি–তারপর পানি দেই…
থাউক দরকার নাই।
গোস্বা হইলেন?
না–গোস্বা হব কেন? গোস্বা হওয়ার মত তো কিছু বল নাই।
ভাব দেইখ্যা মনে হয় গোস্বা হইছেন।
ভাব দেইখ্যা কিছু বোঝা যায় না কুসুম। মানুষের অন্তরের ভাব বড়ই জটিল। সে নিজেই জানে না, অন্যে কি জানব।
কুসুম মুখ টিপে হাসছে। মতি দুঃখিত গলায় বলল, হাস কেন?
বড় বড় জ্ঞানের কথা শুইন্যা হাসি। ছাগল ব্যা কইরা ডাক দিলে ভাল লাগে, আদর করতে মন চায়। ছাগল যখন হালুম ডাক দেয় তখন ভয় লাগে না–হাসি লাগে।
খুবই অপমানসূচক কথা। মতি অণমান গায়ে মাখল না–প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলল, মোবারক চাচার খবর কিছু পাইছ?
না।
চিডিপত্র?
উঁহু।
বল কি! চিন্তার বিষয় হইল। যাই কুসুম, পরে খোঁজ নিব।
মতি চলে যাচ্ছে। কেমন টলতে টলতে যাচ্ছে। কুসুমের খুব মায়া লাগছে। হাত বন্ধ থাকার জন্য সে যে পানি দিচ্ছিল না–তা না। কুসুম এই কথাটা বলেছিল যাতে মতি কিছুক্ষণ বসে। পানি এনে দিলে তো পানি খেয়ে চলেই যাবে।
মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণার একটা হল–মনের কথা বলা যায় না। মনের কথা বলার নিয়ম থাকলে অনেক আগেই কোন এক চান্নিপসর রাতে কুসুম উপস্থিত হত মতির বাড়িতে। মতি অবাক হয়ে দরজা খুললে হাসিমুখে বলত, তারপর অধিকারী সাব, আফনের সংবাদ কি?
মতি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকত–কুসুম বলত, কি সুন্দর চান্নিপসর দেখছেন? মতি আমতা আমতা করে বলত–তুমি অত রাইতে, বিষয় কি?
কুসুম বলত, আফনের ঐ গানটা শুননের খুব ইচ্ছা হইল–চইলা আসলাম।