না আমার এমন কেউ নেই।
যদি থাকে তাকেও আসতে বলে চিঠি লিখে দে–আমি তোক দিয়ে পাঠিয়ে দেব। ও এলে তোদের ভাল লাগবে। সঙ্গে নিয়ে ঘুরবি–দূর থেকে দেখে আমার ভাল লাগবে।
দাদাজান, আমার এমন কেউ নেই।
মহসীন নামের একটা ছেলের কথা তো জানতাম। ওকে কি এখন আর ভাল লাগে না?
শাহানা বিস্মিত এবং কিছুটা হতভম্ব হয়ে বলল–দাদাজান, আপনি স্পাই লাগিয়ে রেখেছেন না-কি?
ইরতাজুদ্দিন হাসিমুখে বললেন–খবর দেবার লোক লাগিয়ে রেখেছি–করব কি–তোরা খবর দিবি না। গত সাত বছরে তোর বাবা কোন চিঠি লিখেনি।
আপনিও লিখেননি।
সে না লিখলে আমি কেন লিখব? আমার কিসের দায় পড়েছে? আমি কি তার খাই না তার পরি? যাই হোক, খবর পাঠাবি মহসীনকে?
না।
ও এলে তুই আনন্দে কাটাচ্ছিস দেখে আমার ভাল লাগত। নয়ত মুখ গোমড়া করে থাকবি…।
মুখ গোমড়া করে থাকব না দাদাজান, যদি সত্যি দশ দিন থাকতে হয়–আমি থাকব। আনন্দেই থাকব।
ঐ ছেলের সঙ্গে এখনও ভাব আছে?
অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করুন তো।
ইরতাজুদ্দিন সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি তাঁর নাতনীর গালে লালচে আভা দেখতে চাচ্ছেন। আজকালকার মেয়ে লজ্জায় লাল হওয়া ভুলে গেছে। হয়ত এই মেয়েও ভুলে গেছে।
কি ব্যাপার দাদাজান, আপনি এভাকে তাকিয়ে আছেন কেন?
ইরতাজুদ্দিনের মুখে হাসি দেখা গেল। না, তাঁর নাতনী লজ্জায় পুরোপুরি লাল হওয়া ভুলে যায়নি। এই তো চোখে-মুখে রক্ত এসে গেছে। মাথা নিচু করে ফেলেছে। তিনি ঠিক করে ফেললেন–চিঠি দিয়ে লোক পাঠিয়ে দেবেন। ছেলে চলে আসুক। এই বাড়িতেই বিয়ের উৎসব করা যেতে পারে। এ পরিবারের শেষ বিয়ে এখানেই হোক। তার মৃত্যুর পর কে কোথায় যাবে বা যাবে না তাতে কিছু আসে যায় না।
শাহানা!
জ্বি।
তোদের শোবার ঘরের টেবিলে চিঠি লেখার কাগজ-খাম সবই আছে। তোর চিঠি লেখার ইচ্ছা হলে লিখে ফেল–আমি লোক মারফত পাঠাব।
দাদাজান, আপনি অসহ্য একটা মানুষ। নীতু ঠিকই বলেছে–আপনি আসলেই খানিকটা বোকা।
শাহানা রাগ করে চলে যাচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন মনে মনে হাসছেন। তিনি তার দুই নাতনীকে নিয়ে সোমবার ভোররাতে যে স্বপ্ন দেখেছেন সেই স্বপ্নের শেষ অংশটি তাদের বলেননি। স্বপ্নের শেষ অংশে পরিষ্কার দেখলেন–শাহানার বিয়ে হচ্ছে এই বাড়িতে। বিয়ে উপলক্ষে তিন গ্রামের সবাইকে তিনি দাওয়াত করেছেন। বিয়ের খাওয়া হচ্ছে তিনদিন তিনরাত ধরে…।
দীর্ঘ দিন তার এই প্রকাণ্ড বাড়ি খালি পড়ে আছে। নীরব নিস্তব্ধ পাষাণপুরী। ভূতের বাড়িতে এরচে বেশি শব্দ হয়। কত রাতে ঘুম ভেঙে ইরতাজুদ্দিন শুনেছেন–বাড়ি কাঁদছে। জনমানবহীন বাড়ি মানুষের সঙ্গের জন্যে কাঁদে। অল্পবয়েসী কচি মেয়েদের গলায় বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে।
আগামী দশদিন এই বাড়ি কাঁদবে না। বাড়ি জেগে ওঠবে। এরচে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। ইরতাজুদ্দিন ডাকলেন, নীতু, নীতু।
নীতু সামনে এসে দাঁড়াল।
এক কাজ কর, বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়ে যা।
কেন?
শব্দ হোক।
শব্দ হোক মানে কি?
কাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাবি, ধুপধাপ শব্দ হবে।
তাতে কি হবে?
বাড়ি ঘুমিয়ে ছিল তো–বাড়ি জাগবে।
নীতু হতভম্ব গলায় বলল, বাড়ি কি কোন জন্তু দাদাজান যে সে জাগবে, ঘুমিয়ে পড়বে?
বাড়ি জন্তু না হলেও বাড়ির প্রাণ আছে। যা, কথা বাড়াবি না, দৌড়ে এ-মাথা ও মাথা কর।
নীতু চোখ সরু করে তার দাদাজানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না।
সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার ফল
সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার ফল ফলেছে। মতি জ্বরে অর্ধ-চেতন। শীতে তার শরীর কাপছে। গায়ে পাতলা চাদর ছাড়া কিছু নেই। চাদরে শীত মানছে না। পানির তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। ঘরে পানিও নেই। কলসি ঠনঠন করছে। মতির মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যাবে। জনমানবহীন এই বাড়িতে মতির বাস করা ঠিক না। মরে পড়ে থাকলেও তৎক্ষণাৎ কেউ কিছু জানবে না। শূন্য ঘরবাড়িতে মতির বাস করার কোন ইচ্ছা নেই, তাকে বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে। বাপ-দাদার ভিটা—মানুষ না থাকলে অকল্যাণ হয়। শূন্য ভিটায় পূর্বপুরুষরা হাঁটাহাঁটি করেন, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। মতি মাঝরাতে এই জাতীয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস শুনেছে।
মতির বাড়ি এক সময় ছিমছাম সুন্দর ছিল। এখন ভগ্নদশা। দক্ষিণের ঘরের অর্ধেকটা গত কালবৈশাখীতে উড়ে গেছে। উড়ে যাওয়া অংশ খুঁজে পাওয়া গেলেও ঠিক করা হয়নি। বাংলোঘরও বাসের অযোগ্য। চালের খড় বদলানো হয়নি। পুরানো খড় পঁচে-গলে গেছে। মধ্যের ঘরটা কোন মতে ঠিক আছে। এই ঘরটা টিনের। মতির বাবা ইদরিছ মিয়ার মৃত্যুর আগে আগে ভীমরতির মত হল। ধানী জমি পুরোটা বিক্রি করে টিনের ঘর তুললেন। নেত্রকোনা থেকে কারিগর এনে ঘরের ভিটা পাকা করালেন। বাড়ির পিছনে টিউবওয়েল বসালেন। ছেলে বিয়ে-শাদী করবে। নতুন বউ এসে উঠবে টিনের ঘরে। পাকা ভিটিতে গরমকালে গা এলিয়ে শুবে। নিজের চাপকলে পানি তুলবে। পানির জন্য অন্য বাড়িতে যেতে হবে না। নতুন বৌয়ের তো একটা ইজ্জতের ব্যাপার আছে। বাপের দেশে গিয়ে বড় গলায় বলতে পারে স্বামীর বাড়িতে টিনের ঘর আছে। নিজেদের চাপকল আছে। এই কথা বলতেপ কত আনন্দ। ইদরিছ মিয়া ছেলের বিয়ে না দিয়েই মরে গেলেন। গ্রামের মানুষ মতিকে ধরল–বাপের বেজায় শখ ছিল তোমার বিবাহ দিবে–এখন বিয়েশাদী করে সংসারধর্ম করো। সংসারধর্ম বড় ধর্ম।