নাশতার টেবিলেও ইরতাজুদ্দিন সাহেব কিছু বললেন না। শাহানা বলল, দাদাজান, আপনি কি আমাদের দুজনকে আসতে দেখে অবাক হননি?
না।
না কেন?
তোরা যে আসবি সেটা জানতাম।
কি ভাবে জানতেন?
স্বপ্নে দেখেছি।
নীতু বিস্মিত হয়ে বলল–স্বপ্ন দেখেছেন?
হুঁ। সোমবার শেষরাতে স্বপ্ন দেখলাম। তোরা দুইজন হাতে দুটা ভারী স্যুটকেস নিয়ে আসছি। আমাকে জিজ্ঞেস করছিস–ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বাড়িটা কোথায়?–আমরা তাঁর নাতনী। আমি স্বপ্নের ভেতরই ভাবছি। আমার নাতনী তো তিনজন। আরেকজন এল না কেন? স্বপ্ন ভাঙতেই শুনি আজান হচ্ছে… তখনই বুঝেছি, তোরা আসছিস। লোকজন এনে ঘর-টর পরিষ্কার করালাম।
শাহানা বলল, সত্যি বলছেন দাদাজান।
হুঁ। তোদের সায়েন্স এসব স্বপ্ন স্বীকার করে না–তাই না?
স্বীকার-অস্বীকারের কিছু না। আপনার মনের মধ্যে ছিল যেন আমরা আসি। এই জন্যেই স্বপ্ন দেখেছেন। মনের ইচ্ছাগুলি স্বপ্নে চলে আসে। আপনি নিশ্চয়ই মাঝে মধ্যে স্বপ্ন দেখেন–দাদীজান এসেছেন। দেখেন না?
দেখি।
দাদীজান কিন্তু আসেন না। মৃত মানুষ আসতে পারে না।
তোর বুদ্ধিও তো ভাল হয়েছে। বাবার মত গাধা হয়ে জন্মাসনি।
কথায় কথায় বাবাকে গাধা বলবেন না দাদাজান, আমার ভাল লাগে না।
যে গাধা তাকে গাধা বলায় দোষ হয় না।
দোষ হয়ত হয় না তবে গাধার মেয়েদের জন্যে মনোকষ্টের কারণ হয়। বিশেষ করে তারা যখন তাদের বাবাকে বুদ্ধিমান হিসেবে জানে।
তোরা তোর বাবাকে বুদ্ধিমান হিসেবে জানিস?
হুঁ।
কেন?
শাহানা জবাব দেবার আগে নীতু বলল–আমরা বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখছি বলেই জানি। আমার কাছে বরং আপনাকে একটু বোকা বোকা লাগছে।
ইরতাজুদ্দিন নীতুর দিকে তাকালেন। তার চোখে হাসি ঝলমল করতে লাগল। তবে মুখ গম্ভীর। নীতু বলল, আশা করি আপনি আমার কথায় রাগ করেননি।
কি জন্যে আমাকে বোকা মনে হচ্ছে সেটা বল, তাহলে রাগ করব না।
আমাদের সামনে একটু পর পর বাবাকে গাধা বলছেন এই জন্যেই আপনাকে বোকা মনে হচ্ছে। কোন বুদ্ধিমান মানুষ এটা করবে না।
ইরতাজুদ্দিন শব্দ করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি বাড়তেই থাকল। নীতুর মনে হল, হাসির শব্দে ঘর-বাড়ি কাঁপতে শুরু করেছে। একটা মানুষ এতক্ষণ হাসতে ধরে পারে! নীতু বিস্মিত হয়ে তার বোনের দিকে তাকাচ্ছে…
ঘাট থেকে ধরাধরি করে একটা পাংগাস মাছ আনা হচ্ছে। মাছের দিকে তাকিয়ে নীতু হকচকিয়ে গেল। এতবড় মাছ। জীবন্ত। ছটফট করছে। ইরতাজুদ্দিন হাসি থামিয়ে বললেন–মাছটা লম্বা করে ধর। নীতু, যা মাছের পাশে গিয়ে দাঁড়া। দেখি, কে লম্বা, তুই না মাছটা।
মাছের সঙ্গে নিজেকে মাপতে ইচ্ছা করছে না দাদাজান।
দাঁড়াতে বললাম। দাঁড়া। আমি বোকা মানুষ, ফট করে রেগে যাব।
নীতু মাছের পাশে দাঁড়াল। দেখা গেল মাছটা তারচে সামান্য বড়। ইরতাজুদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন–এই মাছ খেয়ে আরাম পাবি। খাওয়ার শেষে দেখবি হাতে চর্বি জমে গেছে। সাবান দিয়ে চবি ধুতে হবে।
নীতু বলল–ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগছে।
ঘেন্না-টেন্না ভুলে যা। আমার রাজত্বে এসেছিস, আমার হুকুমমত চলতে হবে। আজ পাংগাস মাছ। কাল খাবি চিতল। হাওরের চিতল–এর স্বাদই অন্য। তোদের শহরের বরফ দেয়া এক মাসের বাসি চিতল না।
শাহানা বলল, আমরা কিন্তু আগামীকাল চলে যাব। বাবাকে তাই বলে এসেছি। আমেরিকায় যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করার শখ ছিল, তাই এসেছি।
তোরা কবে যাবি বা যাবি না সেটা আমি ঠিক করব। সব মিলিয়ে তোরা এখানে থাকবি দশদিন। এই দশদিন যেন আনন্দে থাকতে পারিস সেই ব্যবস্থা আমি করব।
সেটা তো দাদাজান সম্ভব না।
সবই সম্ভব। আমার রাজত্বে সম্ভব।
নীতু বলল, বাবা ভয়ংকর চিন্তা করবে।
চিন্তা করবে না, তাকে খবর পাঠিয়েছি।
নীতু অসহায়ের মত তার আপার দিকে তাকাল।
ইরতাজুদ্দিন কঠিন গলায় বললেন–এই ভাবে তাকালে হবে না। তোর ভুল করে আমার এলাকায় চলে এসেছিস। আমার এলাকা আমার হুকুমে চলে।
শাহানা বলল, আমরা তাহলে বন্দি!
হ্যাঁ বন্দি। আগামী দশদিন আমার রাজত্বে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবি–রাজত্বের বাইরে পা ফেলতে পারবি না।
আপনার রাজত্ব কতদূর পর্যন্ত?
আপাতত, সুখানপুকুর, নিন্দালিশ আর মধ্যনগর এই তিন গ্রাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা এককালে এই তিন গ্রামের জমিদার ছিল।
নীতু বলল, তিন গ্রামের মানুষদের অত্যাচার করে মেরেছে, তাই না?
হ্যাঁ অত্যাচার করেছে। ভয়ংকর অত্যাচার করেছে। জমিদারর কখনো প্রজাদের কোলে বসিয়ে আদর করে না। তাদের খাজনা আদায় করতে হয়। ডাণ্ডা বেড়ি ছাড়া খাজনা আদায় হয় না।
নীতু ভীত মুখে বলল, এখন যদি গ্রামের মানুষ আমাদের উপর সেই অত্যাচারের শোধ নেয় তখন কি হবে! ধরুন আমি একা একা বেড়াতে বের হয়েছি–ওরা ধরে আমাকে শক্ত মার লাগাল—তখন? ইরতাজুদ্দিন তার বিখ্যাত হাসি আবার হাসতে শুরু করলেন–ঘর-বাড়ি কাঁপতে লাগল।
দ্রুতগামী একটা গাড়িকে হঠাৎ ব্রেক কষে থামার মত তিনি হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেলে শাহানাকে বললেন–শাহানা, তুই আয় তো আমার সঙ্গে। তোকে একটা গোপন কথা জিজ্ঞেস করি।..
শাহানা উঠে গেল। ইরতাজুদ্দিন তাকে বারান্দার এক কোণায় নিয়ে গেলেন।
গলা নিচু করে বললেন–তোর কি কোন পছন্দের ছেলে আছে?
শাহানা বিস্মিত হয়ে বলল, পছন্দের ছেলে মানে!
পছন্দের ছেলে মানে–এমন কেউ যাকে খুব পছন্দ? যাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করিস, কফি হাউসে কফি খাস…