নীতু বলল, বাথরুম কোন দিকে?
দূর আছে। শোবার ঘরের ভেতরে টাট্টিখানা এইসব নোংরামি শহরে চলে, এখানে চলে না–আয় আমার সঙ্গে–কই, কদমবুসি করেই রওনা হয়ে গেলি–মুরুব্বীদের সালামের ট্রেনিং বাবা-মা দেন না?
নীতু লজ্জিত ভঙ্গিতে নিচু হল। কদমবুসির নিয়ম-কানুন সে ঠিক জানে না। দুহাত দিয়ে দুপা ছুঁতে হয় না-কি এক হাত দিয়ে? পা ছোঁয়ার পর হাতের আঙুলে চুমু খেতে হয়, না হাতের আঙুল মাথায় ছোঁয়াতে হয়? পা কবার ছুঁতে হয়–একবার না দুবার? নীতুর মনে হচ্ছে–ছোটখাট কোন ভুল করলেই এই মানুষটা ধমক দেবেন। ধমক দেয়াই হয়ত তার স্বভাব।
নীতু পুরোপুরি নিচু হবার আগেই ইরতাজুদ্দিন দুহাতে তাকে ঝাপ্টে ধরে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গি করে আবার ধরে ফেলে বললেন–তোরা এসেছিস, আমি এত খুশি হয়েছি। রাতে তোরা ঘুমুচ্ছিলি, আমি তোদের খাটের মাথায় বসে বসে কেঁদেছি। জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর আমি মোট কবার কেঁদেছি জানিস?–চারবার। প্রথম তিনবার দুঃখে কাদলাম–শেষবার আনন্দে।
নীতু অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে–মানুষটা তাকে কোলে করে আছেন। মনে হচ্ছে। কোলে করেই বাথরুমে নিয়ে যাবেন। কি লজ্জা! আবার তার ভালও লাগছে। বড় হবার পর এত আদর করে কেউ কি তাকে কোলে নিয়েছে? না, কেউ কোলে নেয়নি। এই বুড়ো মানুষের গায়ে শক্তি তো অনেক। কি ভাবে তাকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলে আবার। লুফে নিল…।
নীতু তোর নাম?
হুঁ।
তুই দেখতে যেমন সুন্দর তোর নাম তত সুন্দর না। আমি তোর সুন্দর নাম দিয়ে। দেব। এত আনন্দ হয়েছে তোদের দেখে–কেঁদে ফেলেছিলাম–এই জীবনে। চারবার কাঁদলাম।
চারবার না–পঁচবার। এখনও তো কাঁদছেন।
আরে তাই তো, এখনও তো চোখে পানি এসে গেছে। লক্ষ্য করিনি। নীতু, তোর। তো অনেক বুদ্ধি। তোর বাবা ছিল অকাট গাধা–তার মেয়েগুলি এত বুদ্ধিমতী হবে ভাবাই যায় না।
বাবা মোটেই গাধা না।
বাবার সাফাই গাইতে হবে না। তোর বাবার বুদ্ধি কেমন তা তোরা আমার চেয়ে বেশি জানবি না।
ইরতাজুদ্দিন সাহেব সত্যি সত্যি নীতুকে কোলে করে একেবারে বাথরুমের দরজায় নামিয়ে দিলেন। শুধু শুধু বাথরুমে গিয়ে নীতু করবে কি? তার টুথপেস্ট লাগবে, ব্রাস লাগবে… এই কথা মানুষটাকে বলতেও ইচ্ছা করছে না–বললে তিনি হয়ত আবার কোলে করে ঘরে নিয়ে যাবেন। এ তো দারুণ সমস্যায় পড়া গেল।
শাহানার সঙ্গে ইরতাজুদ্দিন সাহেবের এখনও কথা হয়নি। শাহানার ধারণা, দাদাজান সব কথা জমা করে রেখেছেন–নাশতার টেবিলে কথা হবে। তিনি নিশ্চয়। জানতে চাইবেন–কেন তারা খোঁজখবর না দিয়ে হুট করে চলে এল। কেন কাউকে সঙ্গে আনল না। অথচ তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না। সকালে দেখা হলে জিজ্ঞেস। করেছেন, ঘুম ভাল হয়েছে? তার সঙ্গে এই পর্যন্তই কথা। তার পর পরই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নাশতার আয়োজনে। শাহানা রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে–বড় কড়াইয়ে কি যেন জ্বল হচ্ছে। তিনি খুন্তি হাতে কড়াইয়ের পাশে। বৃদ্ধা একজন মহিলা লম্বা ঘোমটা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে–সে মনে হয় রাধুনী।
শাহানা বলল, দাদাজান, আপনি রান্না করছেন না-কি?
ইরতাজুদ্দিন হাসিমুখে বললেন–হুঁ। তোরা কি ঝাল বেশি খাস না কম খাস?
মোটামুটি খাই।
মুরগির ঝোল ঝাল না হলে মজা নেই। ও রমিজের মা, দেখ, এই হচ্ছে আমার নাতনী। তুখোড় ছাত্রী, ডাক্তার। অসুখ-বিসুখ থাকলে চিকিৎসা করে নিও। এমবিবিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। এখন আমেরিকায় জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ. ডি. করতে যাচ্ছে। কি রে শাহানা, ঠিক বলছি না?
ঠিকই বলেছেন–এত কিছু জানেন কি ভাবে?
আমি সবই জানি। তোরাই আমার ব্যাপারে কিছু জানিস না। আমাকে সাপে কেটেছিল, তোরা জানিস?
না তো। বলেন কি?
দুর্বল ধরনের সাপ। বিষদাঁত ফুটিয়েও বিষ ঢালতে পারেনি, তার আগেই পা দিয়ে কচলে ভর্তা বানিয়ে ফেলেছি।
কি সর্বনাশ!
সাপের জন্যে সর্বনাশ, আমার জন্যে না। আমি তো ভালই আছি। রান্নাঘরের ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি কর, খিদেটা জমুক। চালের আটার রুটি খাস তো?
খাই। পরোটা খেতে চাইলে পরোটা করে দেবে। খাবি পরোটা?।
চালের আটার রুটিই ভাল।
রাঁধতে জানিস?
না
রমিজের মা ট্রেনিং দিয়ে দিবে। তিন দিনে পাকা রাঁধুনি হবি। ডাক্তার মেয়েদেরও তো বেঁধে খেতে হবে।
ধোয়ায় শাহানার কষ্ট হচ্ছিল। সে বারান্দায় চলে এল। বিশাল টানা বারান্দার পুরোটা কাঠের। ধুলো-ময়লা নেই–পরিষ্কার ঝকঝক করছে। কে পরিষ্কার করে এত বড় বাড়ি? রমিজের মা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজের লোক এখনো শাহানার চোখে পড়েনি। তবে আছে নিশ্চয়ই–এত বড় বাড়িতে দুজন মানুষ বাস করে—এটা হতেই পারে না।
শাহানা বাড়ির চারদিক কৌতূহলী হয়ে দেখছে। জায়গাটা অদ্ভুতভাবে অন্যরকম। চারদিকে জেলখানার পাচিলের মত পঁচিল। শ্যাওলা পড়ে ঘন সবুজ হয়ে আছে। পুরো বাড়িটা যেন সবুজ দেয়ালে ঘেরা। বাড়ির পেছনটায় গাছ-গাছালিতে জঙ্গল হয়ে আছে। আম এবং কাঠাল এই দুই ধরনের গাছ ছাড়া শাহানা আর কোন গাছ চিনতে পারছে না। একটা বোধহয় তেতুল গাছ–চিড়ল চিড়ল পাতা। তেতুল। ছাড়া অন্য কোন গাছের পাতা কি এমন চিড়ল চিড়ল হয়? শাহানা জানে না। নিজের দেশের গাছপালা সে নিজে চিনে না–কি লজ্জার কথা! শাহানা ঠিক করে ফেলল, এই গ্রামের সব কটা গাছের নাম সে এবার জেনে যাবে। শুধু যে জানবে তাই না, খাতায় নোট করবে। গাছের বর্ণনা লেখা থাকবে, মোটামুটি ধরনের একটা ছবি আঁকবে এবং গাছের একটা করে পাতা স্কচ টেপ দিয়ে সঁটা থাকবে। গাছগুলি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। বাগানে নামাটা ঠিক হবে কি না শাহানা বুঝতে পারছে না। হাঁটু সমান উঁচু ঘাস। ঘাস না থাকলে বাগানটা বেড়ানোর জন্যে সুন্দর হত। কাঠাল গাছের নিচু ডাল থেকে বড় একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিলে সুন্দর হবে। ভরদুপুরে দোলনায় দোল খেতে খেতে বই পড়ার আনন্দই অন্য রকম।