মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমরার মইধ্যে সবচে ওস্তাদ হইল আফনের পরাণ কাকা। ঢোল বাজায়। হাতের মধ্যে আছে মধু। আহা রে কি বাজনা!
আপনি কি করেন?
আমি গান গাই–গলা ভাল না–মোটামুটি। তয় আফনের দরদ দিয়া গাই–গলার অভাব এই কারণে লোকে ধরতে পারে না।
শাহানা হাসল। মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল–পরাণ কাকার ঢোল শুনলে আফনের সারা জীবন মনে থাকব–আহা কি জিনিস!
শুনব, উনার ঢোল শুনব।
উনার মন-টন বেশি ভাল–স্ত্রীর সন্তান হবে। শেষ বয়সে সন্তান। শেষ বয়সে সন্তান হলে চিন্তা হবারই কথা।
আরেকজন আছে আবদুল করিম, বেহালাবাদক। তয় উনারে এখনো দলে নিতে পারি নাই। চেষ্টায় আছি।
উনিও খুব ভাল?
আমার টেকা থাকলে উনার দুইটা হাত রূপা দিয়া বান্ধাইয়া দিতাম।
সোনা দিয়ে বান্ধাতেন না কেন? সোনা দিয়ে বান্ধানো ভাল না?
পুরুষছেলের জন্যে সোনা নিষিদ্ধ। এই জন্যে রূপার কথা বলেছে।
ও আচ্ছা।
আফনের সঙ্গে অনেক আজেবাজে কথা বইল্যা ফেলছি। মনে কিছু নিবেন না।
কিছু মনে করব না। তাছাড়া আপনি আজেবাজে কথা কিছু বলেননি। সুখানপুকুর আর কতদূর?
বেশি দূর না। আইস্যা পড়ছি। ধরেন আর এক ঘণ্টা।
শাহানা চুপ করে আছে। মতি ক্লান্ত হয়ে লগি কোলের উপর নিয়ে বিশ্রাম করছে।
দূরে কোথাও শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাঝি বলল, আবার বৃষ্টি নামতাছে। এই বছরের মত বৃষ্টি আর কোন বছর হয় নাই। শাহানার শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে ভাঁজ করা একটা চাদর আছে। কার না কার চাদর, গায়ে দিতে ইচ্ছা করে না। নিজের একটা চাদর থাকলে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকা যেত। বৃষ্টি নেমেছে জোরেসোরে। বিলের পানিতে বৃষ্টির শব্দ–কি যে অদ্ভু্ত! কি যে অদ্ভুত!!
ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা থামল তখন দুবোনই ঘুমে অচেতন।
মতি ওদের ঘুম ভাঙল না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবকে খবর দিয়ে নিয়ে এল। সাত ব্যাটারির টর্চ হাতে তিনি নদীর ঘাটে এলেন। মেয়েদের মুখে টর্চের আলো ফেলে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন।
তিনি ব্যাকুল গলায় ডাকলেন–শাহানা, এই শাহানা!
শাহানা জাগল না। সে শুধু পাশ ফিরল।
পায়ের কাছে প্রকাণ্ড জানালা
পায়ের কাছে প্রকাণ্ড জানালা।
শহরের গ্রীলদেয়া জানালা না, খোলামেলা জানালা। এত প্রকাণ্ড জানালা যে মনে হয় আকাশটা জানালা গলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। ঘন নীল আকাশ, যেন কিছুক্ষণ আগে গাদাখানিক নীল রঙ আকাশে লাগানো হয়েছে। রঙ এখনও শুকায়নি। টাটকা রঙের গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।
নীতুর ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ হল। সে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। নৌকায় ঘুমিয়ে পড়ার পর থেকে তার আর কিছু মনে নেই। কখন সে পৌঁছল, কে তাকে এনে বিশাল এই বিছানায় শুইয়ে দিল কিচ্ছু মনে আসছে না। এই তার সমস্যা–একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম ভাঙতে চায় না। এখন ঘুম ভেঙেছে কিন্তু বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে।
বিছানায় পাশাপাশি দুটা বালিশ। আপা আজ রাতে তার সঙ্গে ঘুমিয়েছে–এটা জেনে ভাল লাগছে। রাতে ঘুম ভেঙে সে যদি দেখত এতবড় বিছানায় একা শুয়ে। আছে–অপরিচিত ঘর, চারদিকে সব অপরিচিত আসবাবপত্র, তাহলে ভয়েই মরে যেত।
পুরানো দিনের আসবাবপত্র সব এমন গাবদা ধরনের হয় কেন? খাট এত উঁচু যে গড়িয়ে পড়লে মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যাবে। নীতুর আবার খাট থেকে গড়িয়ে পড়ার অভ্যাস আছে। ভাগ্যিস সে দেয়ালের দিকে শুয়েছিল। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধে গা কেমন কেমন করছে। পুরানো দিনের মানুষরা এত ন্যাপথলিন পছন্দ করে কেন? ওদের গা থেকেও ন্যাপথলিনের গন্ধ বের হয়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে নীতু আঁচ করতে চেষ্টা করল কটা বাজে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না–নীল আকাশ আর নীল আকাশে ধবধবে শাদা মেঘ। এমন শাদা মেঘ শুধু শরৎকালেই দেখা যায়। শ্রাবণ মাসের মেঘে কালো রঙ মাখানো থাকে। আল্লাহর স্টকে বোধহয় কালো রঙ শেষ হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কটা বাজছে নীতু বুঝতে পারছে না। বারান্দায় থপ থপ শব্দ হচ্ছে–মনে হয় চারপায়ে একটা প্রকাণ্ড ভালুক যেন হাঁটছে। ঘরে এসে যে দাঁড়াল সে ভালুকের মতই। এ বাড়ির প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আসবাবের মতই প্রকাণ্ড একটা মানুষ–যার মাথার চুল শাদা। মনে হচ্ছে শাদা রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে তিনি শাদা একটা লুঙ্গি পরেছেন। খালি গা—গা ভর্তি ভালুকের পশমের মত শাদা লোম।
ভালুকটা মেঘের মত গর্জনে বলল, কি রে, এখনও ঘুমুচ্ছিস?
নীতু কিছু বলল না, চোখ পিট পিট করতে লাগল। ভালুকটা বলল, আরো ঘুমুবি? নাকি নাশতা-পানি করবি? তোর জন্যে আমিও না খেয়ে আছি। আমাকে চিনতে পারছিস? চেনার কথা না–একবারই শুধু দেখেছিস তোর যখন তিন বছর বয়স। এখন বয়স কত?
বার।
হুঁ, ন বছর আগের ঘটনা। মনে থাকার কথা না। তুই এত রোগা কেন? নিজে নিজে খাট থেকে নামতে পারবি না-কি কোলে করে নামিয়ে দেব?
নীতু চট করে নেমে পড়ল। ভালুক টাইপ মানুষ হয়ত সত্যি সত্যি কোলে করে নামাতে আসবে।
কোন ক্লাসে পড়িস?
ক্লাস সেভেন।
রোল নাম্বার কত?
পঁচিশ।
রোল পঁচিশ! তুই তো দেখি গাধা টাইপ মেয়ে। পড়াশোনা করিস না?
করি।
পড়াশোনা করলে রোল পঁচিশ কি করে হয়? বল দেখি তিন উনিশে কত?
ফিফটি সেভেন।
হয়েছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়–সব গরম আছে… চালের আটার রুটি আর ঝাল ঝাল ভুনা মুরগি। দুপুরে খাবি পাংগাস মাছ। খাস তো? শহরের মানুষ মাছ খাওয়া ভুলে গেছে…