বালা করছি। পাকিস্তানের খেদমত কর। কিন্তু হাসান আলি একটা কথা।
কী কথা মৌলানা সাব—
শুনতাছি রাজাকার বড়ো অত্যাচার করে। মানুষ মারে, লুটপাট করে, ঘর জ্বালায়। দেইখ বাবা, সাবধান। আল্লাহর কাছে জবাবদিহি হইবা। আখেরাতে নবীজীর শেফায়ত পাইবা না।
মনডা খারাপ হইল। কামড়া বোধহয় ভুল হইল। তখনও আমরার গ্রামের মধ্যে রাজাকার-দল হয় নাই। আমরা হইলাম পরথম দল। সাত দিন হইল টেনিং। লেফট রাইট, লেফট রাইট। বন্দুক সাফ করণের কায়দা শিখলাম, গুলী চালাইতে শিখলাম। বায়োনেট চারজ করতে শিখলাম। মিলিটারিরা যত্ন কইরা সব শিখাইল। তারা সব সময় কাঁইত তুমি সাচ্চা পাকিস্তানী, মুক্তিবাহিনী একদম সাফা কর দে। মানডার মধ্যে শান্তি পাই না। বুকটা কান্দে। রাইতে ঘুম হয় না। আমরার সাথে ছিল রাধানগরের কেরামত মওলা। সে আছিল রাজাকার কমাণ্ডার। আহা, ফেরেস্তার মতো আদমি। আর মারফতি গান যখন গাইত, চিউক্ষে পানি রাখেন যাইত না। মাঝেমধ্যেই কেরামত ভাইয়ের গান শুনতাম–
ও মনা
দেহের ভিতরে অচিন পাখি অচিন সুরে গায়
তার নাগাল পাওয়া দাও
যখন হিন্দুর ঘরে আগুন দেওয়া শুরু হইল, কেরামত ভাই কইলেন, এইটা কী কাণ্ড! কোনো দোষ নাই, কিছু নাই–ঘরে কেন আগুন দিমু? ওস্তাদজী কইলেন–ও তো ইন্দু হ্যাঁয়, গাদ্দার হ্যাঁয়।
কেরামত ভাইয়ের সাহসের সীমা নাই। বুক ফুলাইয়া কইল, আগুন নেই দেঙ্গা।
ওস্তাদজী কইলেন, আও হামারা সাথ। কেরামত ভাই গেলেন। দুই দিন পরে তার লাশ নদীতে ভাইস্যা উঠল। ইয়া মাবুদে এলাহি, ইয়া পরওয়ার দেগার, কী দেখলাম, কী দেখলাম। মাথা একেবারে বেঠিক হইয়া গেল। মিলিটারি যা করে, তাই করি। নিজের হাতে আগুন লাগাইলাম সতীশ পালের বাড়ি, কানু চক্রবর্তীর বাড়ি, পণ্ডিত মশাইয়ের বাড়ি। ইস, মনে উঠলেই কইলজাটা পুড়ায়।
শেষমেষ মিলিটারিরা শরাফত সাহেবের বড়ো পুলাডারে ধইরা আনল। আহা রে, কী কান্দন ছেলের! এখনো চউক্ষে ভাসে। বি… এ… পাশ দিয়া এম… এ… পড়ত। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমন আচারব্যাভার। ভদ্রলোকের ছেলে যেমন হওনের তেমন। এক দিন বাজারে বইয়া আছি। শরাফত সাহেবের পুলাডার সাথে দেখা। আমারে দেইকা কইল, হাছান ভাই, ভাল আছেন? আমি একটা কামলা মানুষ। আমারে আপনে কওনের কী দরকার? কিন্তু সেই ছেলে শিক্ষিত হইলে কী হইব, মনডা ছিল ফিরিশতার। আহা রে, বন্দুকের সামনে দাঁড়াইয়া কেমন কালা হইয়া গেল চেহারাটা। আমি একটু দূরে খাড়াইয়া আল্লাহ্ রসুলের নাম নিতাছি। আমার মাথার গুণ্ডগোল হইয়া গেছে। কী করতাম ভাইব্যা পাই না। শেষকালে ছেলেডা আমার দিকে চাইয়া কইল, হাসান ভাই আমারে বাঁচান। ক্যাপ্টেন সায়েবের পাও জড়াইয়া ধরলাম। লাভ হইল না। আহা রে, ভাই রে আমার। কইলজাডা পুড়ায়। আমি একটা কুত্তার বাচ্চা। কিছু করবার পারলাম না।
সইন্ধ্যা কালে শরাফত সায়েবের বাড়িত গিয়া দেখি, ঘরদোয়ার অন্ধকার। ছেলেডার মা একলা বইয়া আছে। তারে কেউ গুলীর খবর কয় নাই। আমারে দেইক্যা কইল, ও হাছান, আমার ছেলেডা বাঁইচ্চা আছে? আল্লাহর দোহাই-হাছা কথা কইবা।
আমি তাঁর পা ছুইয়া কইলাম, আম্মাজি বাঁইচ্চা আছে, আপনে চাইরডা দানাপানি খান।
সেই রাইতেই গেলাম মসজিদে। পাক কোরআন হাতে লইয়া কিরা কাটলাম। এর শোধ তুলবাম। এর শোধ না তুললে আমার নাম হাছান আলি না। এর শোধ না তুললে আমি বাপের পুলা না। এর শোধ না তুললে আমি বেজন্মা কুত্তা।
রাত্তিরে ক্যাম্পে ফিরতেই হাবিলদার সাব কইলেন পুর্বের বাঙ্কারে একটা লাশ পইড়া আছে, আমি যেন নদীর মধ্যে ফ্যালাইয়া দিয়া আসি।
কী সর্বনাশের কথা! ইয়া মাবুদে এলাহি। গিয়া দেখি কবিরাজ চাচার ছোট মাইয়াটা। ফুলের মতো মাইয়া গো। বারো-তেরো বছর বয়স, ইয়া মাবুদ ইয়া মাবুদ। কাপড় দিয়া শইলডা ঢাইক্যা কইলাম, ভইন, মাপ করিস। এইটা কি, চউক্ষে পানি আসে। কেন? আরে পোড়া চউখ! এখন পানি ফালাইয়া কি লাভ? আগে তো দেখলি না। আগে তো আন্ধা হইয়া রইলি।
সাথের পুলাপানিডির বড়ো পরিশ্রম হইতাছে। আল্লাহ আল্লাহ্ কইরা যদি রামদিয়া ঘাটে পৌঁছাইতে পারি, তয় রক্ষা। ইয়া মান্বুদ, এই পুলাপানডিরে বাঁচাইয়া রাইখো গো। গরম পীরের দরগাত সিনি মানলাম। আমি তিন কালের বুড়া। আমি মন্তব্বলে কী? এক চেয়ারম্যান সাব ছাড়া কেউ এক ফোঁটা চউক্ষের পানি ফালাইত না। মরণের পরে হাসরের মাঠে যদি কবিরাজ চাচার মাইয়ার সাথে দেখা হয়, তয়। মাইয়ার হাত ধইরা কমু, ভইন, শোধ তুলছি। এখন কও তুমি আমারে মাফ দিছ কি দেও নাই।
আবদুল মজিদ
আবদুল মজিদ
এখন বাজছে একটা।
আর এক ঘণ্টার মধ্যে কি রামদিয়া পৌঁছান যাবে? আমার মনে হয় না। হাসান আলিকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কত দূর হাসান আলি?
জানি জবাব দেবে না, তবু জিজ্ঞেস করেছি, কারণ এখান থেকে রামদিয়া কত দূর তা জানে শুধু হাসান আলি। ব্যাটা নবাবের নবাব, কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে না। দেব নাকি রাইফেলের বাঁট দিয়ে একটা–?
খিদে যা পেয়েছে, বলবার নয়। মনে হচ্ছে এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারি। সেবার তালুকদার সাহেবের বাসায় জবর খাইয়েছিল। হারামজাদা ভীতুর একশেষ। মুক্তিবাহিনী এসেছে শুনে ভয়ে পেচ্ছাব করে দেবার মতো অবস্থা। আরো ব্যাটা বলদ, তুই কি দালাল নাকি রে? তুই ভয় পাস কী জন্যে? সারাক্ষণ হাত জোড় করে হে হে হে, কী বিশ্ৰী। তবে যাই হোক, খাইয়েছিল জবর। একেবারে এক নম্বর খানা। পোলাওটোলাও রোধে এলাহি কারবার। জিতা রাহ ব্যাটা। কইমাছ ভাজার স্বাদ এখনো মুখে লেগে রয়েছে। আমাদের খাওয়ার কি আর ঠিক-ঠিকানা আছে? এক বার দুদিন শুকনো রুটি খেয়ে থাকতে হল, সে রুটিও পয়সার মাল। আবু ভাই বলেছিলেন, খিদে পেলে শুধু খাওয়ার কথা মনে হয়। মহসিন হলে ফিস্ট হল এক বার। জনে জনে ফুল রোষ্ট। সেই সঙ্গে কাবাব, রেজালা আর দৈ-মিষ্টি। খেয়ে কুল পাই না। এমন অবস্থা। বাবুর্চি রাধত ফার্স্ট ক্লাস।