জাফরটা ভীষণ গান-পাগল। যেই গুনগুন করে একটু সুর ধরেছি, অমনি সে পিছিয়ে পড়েছে। এখন সে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে। জাফর যাতে ভালোমতো শুনতে পায়, সেই জন্যে আরেকটু উঁচু গলায় গাইতে শুরু করলাম। আমার গুনগুন শুনেই এই? জরীর গান শুনলে তো আর হুঁশি থাকবে না। জাফরকে এক দিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, গান গায় যে কানিজ আহমেদ, তার নাম শুনেছি? সে চমকে উঠে বলল, নজরুল— গীতি গান যিনি, তাঁর কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
খুব শুনেছি। আপনি চেনেন নাকি?
আমি সে-কথা এড়িয়ে গিয়েছি। যুদ্ধটুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে জাফরকে এক দিন বাসায় নিয়ে যাব। জরীকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দেব, এর নাম আবু জাফর শামসুদ্দীন। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আর জাফরকে হেসে বলব, জাফর, এর নাম হল জরী। আমার ছোট বোন। তুমি চিনলে চিনতেও পার, গানটান গায়, কানিজ আহমেদ। শুনেছি হয়তো।
জাফর নিশ্চয়ই চোখ বড়ো করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। সেই দৃশ্যটি আমার বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছে। তা ছাড়া আমার মনে একটি গোপন বাসনা আছে। জরীর সঙ্গে বিয়ে দ্বিয়ে দেব জ্বাফরের। যুদ্ধের মধ্যে যো-পরিচয়, তার চেয়ে খাঁটি পরিচয় আর কী হতে পারে? জাফরকে আমি ভালোভাবেই চিনেছি।
কিন্তু জরীর কি পছন্দ হবে? বড়ো খুঁতখুতে মেয়ে। সমালোচনা করা তার স্বভাব। কেউ হয়তো বাসায় গিয়েছে আমার খোঁজে, জারী আমাকে এসে বলবে, দাদা, তোমার এক জন চ্যাপ্টা মতো বন্ধু এসেছে। অরুণকে সে বলত কাৎলা মাছ। অরুণ রেগে গিয়ে বলেছিল, কাৎলা মাছের কী দেখলে আমার মধ্যে? জরী সহজভাবে বলেছে, তোমার মাথাটা শরীরের তুলনায় বড়ো তো, এই জন্যে। আচ্ছা, রাগ করলে আর বলব না। আদর দিয়ে-দিয়ে মা জরীর মাথাটি খেয়ে বসে আছেন। অল্প বয়সেই অহংকারী আর আহ্লাদী হয়ে উঠেছে।
কে জানে এর মধ্যে বিয়েই হয়ে গেছে হয়তো। অনেক দিন তাদের কোনো খবর পাই না। শুনেছি। বাবা আবার ঢাকা ফিরে এসেছেন। ওকালতি শুরুর চেষ্টা করছেন। দেশে এখন কি আর মামলা–মোকদ্দমা আছে? টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারছেন। কিনা কে জানে।
ঢাকার অবস্থা নাকি সম্পূর্ণ অন্য রকম। কিছু চেনা যায় না। ইউনিভার্সিটি পাড়া খা-খী করে। দুপুরের পর রাস্তাঘাট নিঝরঝুম হয়ে যায়। ঢাকায় বড়ো যেতে ইচ্ছে করে। কত দিন ঢাকায় যাওয়া হয় না। আবার কি কখনো এ-রকম হবে যে নিৰ্ভয়ে ঢাকার রাস্তায় হেটে বেড়াব! সেকেণ্ড শো সিনেমা দেখে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসে চা খেয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরব!
সলিল কিছুদিন আগে গিয়েছিল ঢাকায়। অনেক গল্প শুনলাম তার কাছে। খুব নাকি বিয়ে হচ্ছে সেখানে। বয়স্থা মেয়েদের সবাই ঝটপট বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। ঘরে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। হতেও পারে। সলিল অবশ্যি বেশি কথা বলে, তবুও বিয়ে কি আর হচ্ছে না? বিয়ে হচ্ছে। নতুন শিশুরা জন্মাচ্ছে। মানুষজন হাট-বাজার করছে। জীবন হচ্ছে বহতা নদী।
একি! আবু ভাইয়ের মতো ফিলসফি শুরু করলাম দেখি। আবু ভাই কথায় কথায় হাসাতেন, আবার তার ফাঁকে ফাঁকে এত সহজভাবে এমন সব সিরিয়াস কথা বলে যেতেন–আশ্চর্য! আবু ভাই তাঁর অসংখ্য ভক্ত রেখে গেছেন, যারা তাঁকে দীর্ঘ দিন মনে রাখবে। এই–বা কম কী?
এক দিন হস্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন আবু ভাই। দারুণ খুশি-খুশি চেহারা। মাথার লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে বললেন, হুমায়ূন, গুড নিউজ আছে। মিষ্টি খেতে চাও কিনা বল।
চাই চাই।
ভেরি গুড নিউজটা পরশু শোনাব। মিষ্টি যোগাড় করি আগে, তার পর। পরশু। সন্ধ্যায় সবাইকে মিষ্টি খাওয়াব।
সেই গুড নিউজটি শোনা হয় নি। দারুণ ব্যস্ততা শুরু হল হঠাৎ ছড়িয়েছিটিয়ে পড়লাম সবাই। এবং সবশেষে আবু ভাই গেলেন মেথিকান্দা।
আবু ভাইয়ের লাশ হাসান আলি বয়ে এনেছিল। বিশেষ কোনো কথাবার্তা বলে নি। হাউমাউ করে কাঁদেও নি। অথচ সবাই সেদিন বুঝেছিলাম, হাসান আলির মন ভেঙে গেছে।
মজিদ ডাকল, পা চালিয়ে হুমায়ূন ভাই, আপনি বারবার পিছিয়ে পড়ছেন। হাসান আলি দেখি হন।হন করে এগিয়ে চলছে। এত চুপচাপ থাকে কেন লোকটা?
হাসান আলি
হাসান আলি
চেয়ারম্যান সাব কইলেন, হাসান আলি রাজাকার হইয়া পড়। সত্ত্বর টাকা মাসমাইনা, তার সাথে খোরাকি আর কাপড়।
চেয়ারম্যান সাব আমার বাপের চেয়ে বেশি। নেকবক্ত পরহেজগার লোক। তাঁর ঘরের খাইয়া এত বড়ো হইলাম। আমার চামড়া দিয়া চেয়ারম্যান সাহেবের জুতা বানাইলেও ঋণ শোধ হয় না। তাঁর কথা ফেলতে পারি না। রাজাকার হইলাম।
জুম্মাবাদ চেয়ারম্যান সাব আর তাঁর বিবিরে কদমবুসি কইরা গাঁটরি মাথায় লইলাম। চেয়ারম্যান সাব কইলেন, আল্লাহর হাতে সোপর্দ হাসান আলি, আল্লাহ নেকাবান। সাচ্চা দিলে কাম করব। হালাল পয়সা খাইবা।
যাওনের আগে মসজিদে গেলাম দেওয়া মাঙতে। গিয়া দেখি মান্বুদে এলাহি–মসজিদের মাথার উপর শকুন বইয়া আছে। দুই কুড়ির উপরে বয়স তুমি, এত বড়ো শকুন দেখি নাই। মনডো বড়ো টানল। বুকের মধ্যে ছ্যাৎ কইরা উঠল।
আরো একবার মসজিদের উপরে শকুন বইছিল। আমি তখন ছোড। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে গরু-রাখালের কাম করি। বাপজান কইলেন, হাছান, শকুন বইছে মসজিদে। বড়ো খারাপ নিশানা। কেয়ামত নজদিক। বালা-মুসিবত আইব। বাপজানের কথা মিছা হয় নাই। কলেরায় দেশটা সাফা হইয়া গেল!
মসজিদে মওলানা সাব কইলেন, হাসান, তুমি রাজাকার হইতোছ শুনলাম।
হ মৌলানা সাব। দোওয়া মাঙতে আইছি।