জ্বি না। তয় রাজাকার আইছিল দুই বার। রমেশ মালাকাররে বাইন্ধা লইয়া গেছে। গয়লা পাড়া পুড়াইয়া দিছে।
রাজাকারদের কেউ খাতির যত্ব করেছিল নাকি?
জ্বি না, জ্বি না।
এই গ্রামের কেউ রাজাকারে নাম লেখাইছে?
লোকগুলি চুপ করে রইল। জাফর ধমকে উঠল, বল ঠিক করে।
এক জন গেছে। কী করব মিয়া সাব, পেটে ভাত নাই। পুলাপানিডি ক্যান্দে।
আমি বললাম, দেরি হয়ে যাচ্ছে, চল হাঁটা দিই।
আনিসের বোধহয় কিছু কথা বলবার ইচ্ছে ছিল। সে অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল।
আনিসের এই স্বভাব আমি লক্ষ করেছি। মানুষের সপ্রশংস চোখ তার ভারি প্রিয়। যখনি আমাদের ঘিরে কিছু কৌতূহলী মানুষ জড় হয়, তখনি সে খুব ব্যস্ত হয়ে এল এম জি র ব্যারেল নাড়তে থাকে বা খামকাই গুলীর কেন্সটা খুলে ফেলে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে এমন একটা ভঙ্গি করে, যেন ভারি বিরক্ত হয়েছে। বক্তৃতা দিতেও তার খুব উৎসাহ দেশের এই দুদিনে আমাদের কী করা উচিত, এ সম্বন্ধে তার সারগর্ভ ভাষণ তৈরী। টেপ রেকর্ডারের মতো।–চালু করে দিলেই হল। গ্রামে গ্রামে প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করতে হবে। চোর, ডাকাত, দালাল নিমূল করতে হবে। দখলদার বাহিনীকে দাঁত-ভাঙা জবাব দিতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। বক্তৃতা শেষে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বিকট সুরে চেঁচিয়ে ওঠে-জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!
আনিস ছেলেটিকে আমি খুব পছন্দ করি। চমৎকার ছেলে, একটু পাগলাটে। অপারেশনের সময় সব বিচারবুদ্ধি খুইয়ে বসে। গুলী ছেড়ে এলোপাথাড়ি। পেছনে সরতে বললে ক্রল করে সামনে এগিয়ে যায়। সামনে এগুতে বললে আচমকা পেছন দিকে দৌড় মেরে বসে।
মেথিকান্দায় প্রথম অপারেশনে গিয়েছি। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, একেবারে ফাঁকা ক্যাম্প। চার জন পশ্চিম পাকিস্তানী রেঞ্জার আর গোটা পনের রাজাকার ছাড়া আর কেউ নেই। রাত দুটোয় অপারেশন শুরু হল। আমি আর সতীশ গর্তের মতো একটা জায়গায় পজিশন নিয়েছি। বেশ বড়ো দল আমাদের। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। দলের নেতা হচ্ছেন আবু ভাই। কথা আছে পশ্চিম দিক থেকে আবু ভাই প্রথম গুলী চালাতে শুরু করবেন, তার পরই মাথা নিচু করে খালের ভেতর দিয়ে চলে আসবেন আমাদের কাছে। আমরা সবাই পূর্ব দিকে বসে আছি। আনিস আর রমজান উত্তরে একটা মাটির টিবির আড়ালে চমৎকার পজিশন নিয়েছে। রমজান খুব ভালো মেশিনগানার। বসে আছি তো আছিই, আবু ভাইয়ের গুলী করার কোনো লক্ষণই দেখি না। সবাই অধৈৰ্য হয়ে উঠেছি। আচমকা আমাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলীবর্ষণ হতে লাগল। আমরা হতবুদ্ধি। অবশ্যি সবারই পজিশন ভালো। গায়ে গুলী লোগবার প্রশ্নই ওঠে না। তবু একদল ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল আর তার পরই মর্টারে গোলাবর্ষণ হতে লাগল। আমাদের দিকে সবাই চুপচাপ। হতভম্ভ হয়ে গিয়েছি। রমজান মিয়া এই সময় উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কেউ ভয় পাবেন না, কেউ ভয় পাবেন না।
তার পরই রমজান মিয়ার মেশিনগানের ক্যাটিক্যাট শব্দ শোনা যেতে লাগল। সতীশকে বললাম, শুরু করা দেখি, আল্লাহ ভরসা। আর তখনি মর্টারের গোলা এসে পড়ল। বারুদের গন্ধ ও ধোঁয়ায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ধোঁয়া পরিষ্কার হতেই দেখি আমি আনিসের কাধে শুয়ে। আনিস প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছে। সবাই যখন পালিয়েছে, সে তখন জীবন তুচ্ছ করে খোঁজ নিতে এসেছে আমার। মেথিকান্দার সেই যুদ্ধে আমাদের চার জন ছেলে মারা গেল। রমজান মিয়ার মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হারলাম।
গুলী লেগে আবু ভাইয়ের ডান হাতের দুটি আঙুল উড়ে গেল। আবু ভাই তারপর একেবারে ক্ষেপে গেলেন। পাঁচ দিন পরই আবার দল নিয়ে এলেন মেথিকান্দায়। সেবারও দটি ছেলে মারা গেল। তৃতীয় দফায় আবার এলেন। সেবারও তাই হল। মিলিটারিরা তত দিনে মেথিকান্দাকে দুৰ্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করিয়েছে। চারিদিকে বড়ো বড়ো বাঙ্কার, রাত-দিন কড়া পাহারা। গুজব রটে গেল, মেথিকান্দা মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ। সতীশ বলত, যদি বলেন তাহলে গভর্ণর হাউসে বোমা মেরে আসব, কিন্তু মেথিকান্দায় যাব না, ওরে বাপ রে।
কিন্তু আবু ভাইয়ের মুখে অন্য কথা, মেথিকান্দা আমিই কাজ করব। যদি না পারি, তাহলে গু খাই। চতুৰ্থ বারের মতো তিনি বিরাট দল নিয়ে গেলেন সেখানে। সবাই ফিরল, আবু ভাই ফিরলেন না।
পঞ্চম বারের মতো যাচ্ছি। আমরা। আমার কি ভয় লাগছে নাকি? ছিঃ হুমায়ূন ছিঃ একটির পর একটি জায়গা তোমাদের দখলে চলে আসছে, মেথিকান্দায ঘাঁটি করে এক বার যদি সোনারদির রেলওয়ে ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বিরাট একটা অংশ তোমাদের হয়ে যাবে। আর এত ভয় পাওয়ারই—বা কী? মৃত্যুকে এত ভয় পেলে চলে? একটা গল্প আছে না–এক নাবিককে এক জন সংসারী লোক জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবা কোথায় মারা গেছিলেন?
তিনি নাবিক ছিলেন। সমুদ্রে জাহাজ ড়ুবি হয়ে মরেছেন।
আর আপনার দাদা?
তিনিও ছিলেন নাবিক। মরেছেন জাহাজ ড়ুবিতে।
সংসারী লোকটি আত্মকে উঠে বলল, কী সর্বনাশ! আপনিও তো মশাই নাবিক। আপনিও তো জাহাজ ড়ুবি হয়ে মরবেন!
নাবিকটি বলল, তা হয়তো মরব। কিন্তু নাবিক না হয়েও আপনার দাদা বিছানায় শুয়ে মরেছেন, ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ।
আপনার বাবাও বিছানাতেই মরেছেন, নয় কি?
হ্যাঁ, হাসপাতালে!
আপনিও সেইভাবেই মরবেন। তাহলে বেশ-কমটা হল কোথায়?
আসল কথা, আমার ভয় লাগছে। সাহস সঞ্চায়ের চেষ্টা করছি। ভয় পাওয়াতে লজ্জার কিছু আছে কি? আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এই মনে করে গুনগুন করে গান গাইতে চেষ্টা করলাম।–সেদিন দুজনে। শিস দিয়ে আমি বেশ ভালো সুর তুলতে পারি। কিন্তু গান গাইতে গেলেই চিত্তির। জরী বলে, তোমার মীড়গুলি খুব ভালো আসে, আর কিছুই হয় না। কি জানি বাবা, মীড় কাকে বলে। আমি এত সব জানি না। আমি তো তোর মতো বিখ্যাত শিল্পী নই, গান নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নেই। বাথরুমে গোসল করতে করতে একটু গুনগুন করতে পারলেই হল।